গোয়ালন্দে মাদকের ভয়াবহতায় নিভে গেল কর্মঠ একটি প্রাণ, অনিশ্চয়তায় পুরো পরিবার
- Update Time : ১০:৪১:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
- / ১৪৭ Time View
আজু শিকদার, রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
‘আমার কামাইসুদ (উপর্জনক্ষম) ছেলেডার যে কি হইল, কাম বাদ দিয়া খালি টাহা চাইত, আর কইত টাহা না দিলে ওরা আমারে মাইরা ফালাইবো। আতের (হাতের) কাছে যা পাইত বেইচা টাহা নিয়া কৈ যেন চইলা যাইত। হ্যাসপন্ত ওরা আমার ছেলেডারে মাইরাই ফালাইল।’ এ ভাবেই বিলাপ করছিল গত ৪ জুন মাদকের ভয়াবহতায় প্রাণ হারানো কাশেম শেখের মা খোদেজা বেগম।
ভৌগলিক কারণেই রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলা মাদকের আগ্রাসন একটু বেশী। কারণ এ উপজেলায় নদীবন্দর ছাড়াও রয়েছে দেশের সর্ববৃহত যৌনপল্লী। মাদকের ভয়াল থাবায় গত ৪ জুন মৃত্যু হয় কাশেম শেখ (৪০) নামের এক ব্যাক্তির। যদিও পরিবারের দাবি হত্যা, কিন্তু পুলিশ বলছে আত্মহত্যা। সেটা যাই হোক, কাশেমের মৃত্যুর কারণ যে মাদক, এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। তিন শিশু সন্তান নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন কাশেমের অসহায় স্ত্রী সীমা আক্তার। এখনই মাদকের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে একই পরিনতির শিকার হতে হবে অনেক পরিবারের।
গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের দুদুখান পাড়া গ্রামের নির্জন বাঁশঝাড়। এখানেই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত বসে মাদক ও জুয়াড় জমজমাট আড্ডা। সে আড্ডায় সামিল হয় স্থানীয় বিভিন্ন বয়সের মানুষ ও দুর দুরান্ত থেকে আসা মানুষও। পরিবারের অজান্তেই তিন সন্তানের জনক কর্মঠ কাশেম জড়িয়ে পড়ে সেই আড্ডায়। গত ৪ জুন সেই বাঁশঝার থেকে উদ্ধার করা হয় তার ঝুলন্ত মরদেহ। তার স্ত্রী ও মায়ের দাবি কাশেমকে খুন করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তবে পুলিশের ধারনা সে আত্মহত্যা করেছে। কাশেমের মৃত্যুতে ওই পরিবারটি এখন বেঁচে থাকার সব পথ যে হারিয়ে ফেলেছে। কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা কাশেমের স্ত্রী যেন সেটাই বোঝাচ্ছিলেন।
নিহত কাশেমের চাচা সাহেব আলী শেখ জানান, তার ভাতিজা একজন ইটভাটার দক্ষ কারিগর ছিল। আয়রোজগারও ভালোই ছিল। বিয়ে করে সন্তান-সন্ততি নিয়ে ভালোই চলছিল কাশেমের সংসার। হঠাৎ করে ওর যে কি হয়ে গেল? নেশায় জড়িয়ে কাজ কর্ম ছেড়ে সহায় সম্বল বিকিয়ে শুধু টাকার জন্য পাগলের মত আচরন করত। স্ত্রী সন্তানদের চিন্তাও ছেড়ে দিয়েছিল। বড় মেয়েটি ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী, ৩ বছরের আরো একটি মেয়ে ও ১০ মাসের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে কাশেমের।
নিহত কাশেমের মা খোদেজা বেগম দাবি করেন, তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। নেশার টাকার জন্য তাকে অব্যহত ভাবে তাকে চাপ দিতো মাদকের আড্ডায় থাকা কিছু মাদকসেবী। তারাই তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
নিহত কাশেমের স্ত্রী সীমা আক্তার বিলাপ করতে করতে বলেন, তার স্বামী একটু অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরও তার স্বামীর সাথে তার কোন প্রকার ঝগড়া-বিবাদ হতো না। আর তার স্বামী আত্মহত্যা করবে এমন কোন ঘটনাও ঘটেনি। আমরা বিশ^াস করতাম যে, সে একদিন ঠিকই নেশার জগৎ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। এ কথাগুলো বলতে বলতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. চুন্নু মীরমালত বলেন, স্থানীয় ও বাইরে থেকে এখানে দলে দলে এসে মাদকের আড্ডা বসাতো। এতে এ এলাকার অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। তিনি এই এলাকাকে মাদকমুক্ত করার দাবি জানান প্রশাসনের কাছে।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক নাছরিন আক্তার ইতি বলেন, এ এলাকা মাদকের ভয়াবহতা প্রকোপ আকার ধারন করেছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে এর প্রভাব পড়েছে। মাদকের কারণে এইযে কর্মক্ষম একজন ব্যক্তির মৃত্যু হল, তার পরিবারটির এখান কি অবস্থা হবে? এমনিতেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি নেশায় জড়িয়ে যাওয়ায় পরিবারটি চরম দুরাবস্থার মধ্যে ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুতে পুরো পরিবারের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছে।
উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলজার হোসেন মৃধা বলেন, কাশেম হত্যা বা আত্মহত্যা যাই হোক, সেটা মাদকের কারণে হয়েছে। মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা কমিটিসহ বিভিন্ন সভায় প্রশাসনকে অবগত করেছেন। প্রশাসনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহন করে জড়িতদের আইনের আওতায় এনেছেন। তবে এখনো মাদকের ব্যবহার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
এদিকে থানা পুলিশের অভিযানে গত ১ জুন ৬৭ গ্রাম হেরোইন সহ ২জন, ২৫০ গ্রাম গাঁজাসহ ১জন, ৫ জুন ৪শ গ্রাম গাঁজাসহ ১জন ও ১১ জুন ১০ গ্রাম হেরোইনসহ ১জনকে গ্রেপ্তার করে। অপরদিকে রাজবাড়ী জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গোয়ালন্দ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত ২ জুন ২৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ৩ জনকে, ৬ জুন ৩০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ১ জনকে, ৮ জুন ৩২৫ লিটার দেশীমদ সহ ২ জনকে, ১০ জুন ৩০০ গ্রাম গাঁজাসহ ১ জনকে গ্রেপ্তার করে। চলতি মাসের ১১ দিনে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন মাদকসহ মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) স্বপন কুমার মজুমদার জানান, উজানচর ইউনিয়নের দুদুখান পাড়া গ্রামের ওই নির্জন বাঁশঝাড়ে মাদকের আড্ডার বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। একটি মৃত্যুর ঘটনায় এটি তাদের নজরে এসেছে। গুপ্তচর নিয়োগ করে খবর রাখা হচ্ছে, এরপর এ ধরনের কোন আড্ডার খবর পেলে সেখানে অভিযান চালিয়ে মাদকমুক্ত করা হবে। এছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান প্রতিনিয়ত চলছে। দুদুখান পাড়া এলাকায়ও তারা মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছেন।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়