ফুটবল বিশ্বকাপ: “উন্মাদনা নয়, চাই নির্মল আনন্দ” : লেখক- শিপন আলম
- Update Time : ০৫:৩৬:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২২
- / ১০৭ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
ঘটনাটি অতি সাম্প্রতিক। চাঁদপুর জেলা সদরের দক্ষিণ নানুপুর এলাকার দুই কিশোর মেহেদি ব্যাপারী ও বরকত ব্যাপারীর মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। দুজনই সবে ১৮ তে পা দিয়েছে। তারা একসাথে খাইতো, ঘুরতো, লেখাপড়া করতো, আড্ডা দিতো। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ন্যায় চলমান ফুটবল বিশ্বকাপ উন্মাদনা তাদের কিশোর মনকেও আন্দোলিত করে। দুজন একই দলের সমর্থক হলে হয়তো তাদের বন্ধুত্ব আরো প্রগাঢ় হতো। কিন্তু ট্র্যাজেডিটা এখানেই। মেহেদি ব্যাপারী ছিলো ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থক আর বরকত ব্যাপারী আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের। প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ সৌদি আরবের বিপক্ষে হেরে যায়। এমন অভাবনীয় হারে মেসিদের ন্যায় এদেশের কোটি কোটি আর্জেন্টিনা ভক্তও হারের যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে থাকে। তাদের যন্ত্রণা আরো বেশি করে তোলে ব্রাজিল ভক্তদের অযাচিত উস্কানি, টিপ্পনি। বিরাজমান এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পায় নি চাঁদপুরের কিশোর এ দুই বন্ধু। ব্রাজিল ভক্ত মেহেদি ব্যাপারীর অনবরত ঠাট্টা, অপমানে উত্তেজিত হয়ে ছুরিকাঘাত করে বসে আর্জেন্টিনা ভক্ত বরকত ব্যাপারী। রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায় নি মেহেদি ব্যাপারীকে। সব উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে সে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আর বরকত ব্যাপারীর ঠিকানা হয় জেলখানা। এভাবেই ফুটবল বিশ্বকাপ উন্মাদনার শিকার হয়ে দুই কিশোরের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বরণ করতে হয়।
উল্লেখিত ঘটনাটি গত ২৮ নভেম্বরের। ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা এদেশে হর হামেশাই দেখা যায়। এই যেমন কয়েক দিন আগে টিভির স্ক্রলে নিউজে দেখলাম প্রিয় দলের পতাকা উপরে বাঁধতে গিয়ে বৈদ্যুতিক তারের সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই কিশোরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অতীতেও প্রিয় দলের দেশের পতাকা গাছের উপরে বাঁধতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে অনেক কিশোর যুবকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি, হাতাহাতি, রক্তারক্তিও এদেশে নতুন ব্যাপার নয়।
বিশ্বকাপ এলেই এদেশ নব উন্মাদনায় মেতে ওঠে। টেলিভিশন বিক্রির সংখ্যা বেড়ে যায় অনেক। ঘরে ঘরে, ভবনের ছাদে, গাছের মাথায়, গাড়িতে গাড়িতে প্রিয় দলের দেশের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। পতাকা, জার্সি, ফুটবল এ সময় বিক্রি হয় দেদারছে। কোন দলের সমর্থক বড় পতাকা বানালো তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বাজারে বা শপিং মার্কেটে বাজার দোকানদারগণ চাঁদা তুলে পতাকা বানিয়ে টানিয়ে রাখে। শিশু কিশোররাও এ উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দেয়। জার্সি বা পতাকার জন্য তারা বাবা মার কাছে পীড়াপীড়ি করে। দরিদ্র বাবা মা কষ্ট হলেও তাদের প্রিয় সন্তানের পছন্দের পতাকা ও জার্সি কিনে দেয়।
কেউ কেউ লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাড়ির রঙ করে প্রিয় দলের জার্সি বা পতাকার রঙে। পছন্দের জার্সি পড়ে, পতাকা হাতে নিয়ে মোটর সাইকেল শোভাযাত্রা বা মিছিল করতেও দেখা যায় অনেক জায়গায়। বিশ্বকাপের পুরো মাস বিভিন্ন জায়গায় বড় পর্দায় খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হলগুলো সারাক্ষণ বিশ্বকাপের আমেজে মেতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মোহসীন হল মাঠে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কর্তৃক জায়ান্ট স্ক্রিনে গ্যালারি স্টাইলে খেলা দেখার মুহুর্তের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবি বলে দেয় খেলার প্রতি এদেশের মানুষের দূর্বলতা কতটুকু।
বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আনন্দ উৎসবও কম হয় না। পাড়ায় পাড়ায় সমর্থকদের মধ্যে প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করা হয়, খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা হয়, গরু খাসি জবাই করে উৎসব করা হয়, প্রিয় দলের শুভ কামনায় অনেকে মিলাদও দেয়। চায়ের দোকানে, মাঠে ঘাটে, বাজারে সবখানেই, সবার মুখেই তখন স্থান পায় ফুটবল কথন। বিভিন্ন দলের সমর্থক গোষ্ঠী ফেসবুকে নতুন নতুন গ্রুপ খুলে তাদের দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারনায় নেমে পড়ে। টেলিভিশন, নিউজপেপারগুলো এ সময় বিশ্বকাপকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে, বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে। মোটকথা ফুটবলের আশ্চর্য এক সম্মোহনী শক্তিতে পুরো জাতি যেন উন্মাতাল হয় এ সময়।
বিশেষ পরিস্থিতি ব্যতীত প্রতি চার বছর পর পর ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শো। তাই এটি নিয়ে আনন্দ হবে, উল্লাস হবে, উৎসব হবে এমনটিই স্বাভাবিক। আমাদের প্রত্যেকের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেক সুখকর স্মৃতি জড়িয়ে আছে ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার সঙ্গে।
যে বিশ্বকাপ আমাদের নির্মল আনন্দ উপহার দেয়, সুখকর ও উপভোগ্য মুহুর্ত সৃষ্টি করে সে বিশ্বকাপই কখনো কখনো আমাদের মনে প্রচণ্ড উন্মাদনা সৃষ্টি করে যা আমাদের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এমনকি জীবনকে নষ্ট করে দেয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পতাকা বানানো, অযাচিতভাবে বাড়ির রঙ করা মোটেই শোভনীয় বিষয় হওয়া উচিৎ নয়। আবার পছন্দের দলের সমর্থন করা নিয়ে অহেতুক তর্কাতর্কি, মারামারি, হানাহানি, জীবনহানি আমাদের অসভ্যতা, অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতাকেই প্রকাশ করে।
তাই বিশ্বকাপ খেলা দেখার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ আনন্দ লাভ করা, উন্মাদনা প্রদর্শন নয়।
আনন্দ-উল্লাস, উদযাপন আর উপভোগের ক্ষেত্রে পরিমিতবোধই আমাদের উন্মাদনাকে অবদমিত করে বিশ্বকাপকে নির্মল বিনোদনের উৎস হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি শিশু কিশোরদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। অভিভাবকদের উচিৎ তাদের সন্তানদের উৎসব আর উন্মাদনার মধ্যে ব্যবধান সম্পর্কে অবগত করা। তাদের মধ্যে মিতব্যয়িতা আর পরিমিতবোধের ব্যাপারটি জাগ্রত করা। সংবাদ মাধ্যমের উচিৎ এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক বিভিন্ন নিউজ পরিবেশন করা। কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপও জরুরি। সবার সচেতনতা, পরিমিতবোধ আর সহিষ্ণুতার মাধ্যমে প্রতি বার ফুটবল বিশ্বকাপ আমাদের আনন্দ উপভোগের মাধ্যম হিসেবে ধরা দিক এমনটিই চাওয়া। মেহেদি ব্যাপারী আর বরকত ব্যাপারীর মতো আর কোন তরুণের যেন করুণ পরিণতি বরণ করতে না হয় তেমনটিই কামনা করি।
লেখক- শিপন আলম, (৩৪তম বিসিএস ব্যাচ), প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ, টাঙ্গাইল।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়