ছেলেবেলার টেলিভিশন দেখা (দ্বিতীয় পর্ব) : লেখক- শিপন আলম
- Update Time : ০৯:৪৫:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৩
- / ২৮৫ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
১৯৯৮ সালে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বন্যা হয় দেশে। আমার দেখা সেটিই সবচেয়ে সেরা ও ভয়ঙ্কর বন্যা। আমাদের বাড়িঘর সব পানিতে ডুবে যায়। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। স্কুলের নাম ছিলো ৭১ নং পশ্চিমপাড়া রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমাদের পাড়াতেই এটির অবস্থান ছিলো। পরে এটি সরকারিকরণ হয়েছে এবং নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বর্তমান পাড়াতেই এটির ঠাঁই হয়েছে। সেটিও সে সময় পানিতে ডুবে যায়। অনেক পরিবারের ঠাঁই হয় পাকা রাস্তার ওপাড়ে স্কুল কলেজের কক্ষগুলোতে। আর গবাদিপশুর আশ্রয় হয় রাস্তার উপরে। সে সময় আমি আর আমার বড় ভাই মায়ের সাথে চৌকির উপরে থাকতাম। আব্বা রাস্তার দিকে গরু পাহারা দিতো। ওইদিকেই কোন একটা জায়গায় হয়তো থাকতেন। আমাদের চৌকির নিচ দিয়ে প্রায় হাঁটুর নিচ পর্যন্ত পানি গড়াগড়ি খেতো। গোয়ালঘরটা একটু উঁচু থাকায় সেখানে পানি প্রবেশ করেছিল বটে কিন্তু একেবারে ডুবে যায় নি। আমরা চৌকির উপরে বসে টেংরা বা পুঁটি জাতীয় মাছ ধরতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একবার মোটামুটি বড় একটি মাগুর মাছ বেড়ার ফাঁক দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে আর দাঁড়ি নাড়াতে নাড়াতে আমাদের চৌকির দিকে আসতে থাকলে আমি বা আমার বড় ভাই একটা কাঁচি দিয়ে সেটিকে সজোরে কোপ মারি। কোপটি মাগুরটির গায়ে লাগে বটে কিন্তু সেটি সেখান থেকে তৎক্ষনাত পলায়ন করে কোথায় হারিয়ে যায় আর খুঁজে পাই নাই। পরে গিয়ে হয়তো মারা গিয়েছিল কিন্তু আমাদের রিজিক হিসেবে সেটি ছিলো না।
সেই ভয়াবহ বন্যার সময়ও আমি উঠোনের পানি মাড়িয়ে কাকার বাড়ির জানালা দিয়ে টিভি দেখতে যেতাম। সে সময় বোধ হয় মঙ্গলবারে ‘হাতেম তাঈ’ বা ‘রবিনহুড’ হতো। সেটি দেখতে যাওয়ার নেশায়ই এমনটি করতাম। কিন্তু প্রতিবারই মন খারাপ করে চলে আসতাম। কারণ তখন সব অনুষ্ঠান বন্ধ ছিলো। টিভিতে শুধু বন্যা আর ত্রাণের খবর প্রচার করতো। মেজাজটা খারাপ হয়ে যেতো। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রি কারা ছিলো এসব তখন মাথায়ই ছিলো না। আমার শুধু চাওয়া ছিলো ‘আলিফ লায়লা’, ‘হাতেম তাঈ’ আর ‘রবিনহুড’ কবে হবে!
বন্যা শেষ হওয়ার অনেক দিন পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে ‘আলিফ লায়লা’ শুরু হয়। আমরাও স্বস্তি নিয়ে আবার দেখা শুরু করি।
কাকাদের সাথে আমাদের মাঝে মাঝে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া লাগতো- গ্রামে যেমনটি হয়। তখন আমাদের তাদের বাড়িতে টিভি দেখা বন্ধ হয়ে যেতো। আবেগের বশে কখনো গেলে মা আগের মতোই ডায়লগ শুনিয়ে দিতো- “পাঁচ ছাওয়ালের কোনোডাই টিভি দেহে না, জ্বালা অয়ছে ছোট দুডের নিয়ে”। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা তখন বাইরেই টিভি দেখতে যেতাম।
আমাদের বাড়ির সাথে একেবারে লাগোয়া ছিলো আমার প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোবাহান স্যারের বাড়ি। স্যারের মিসেসও (রোকেয়া খাতুন) আমাদের ম্যাডাম ছিলেন। আমি তখন স্যারের স্কুলের অন্যতম ভালো ছাত্র। ক্লাসে আমার রোল নম্বর ছিলো দুই। আমার এক বান্ধবী ছিলো মুন (পুরো নাম রিফাত আমিন মুন)। ও ছিল আরেক ম্যাডাম দিলরুবা ম্যাডামের মেয়ে (ম্যাডাম মারা গিয়েছেন- তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি)। ওর রোল নম্বর বরাবরই এক ছিলো। ও মূলত পাংশা কিন্ডারগার্টেনের ছাত্রী ছিলো। আমি দুই একটি বিষয়ে ওর চেয়ে ভালো নম্বর পেলে শুনেছি ও মন খারাপ করতো। আমার এসব মন খারাপের বিষয় ছিলো না কারণ আমার নাম্বার বাবা-মা বা পরিবারের কেউই জিজ্ঞেস করতো না। পঞ্চম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। তাছাড়া ও সব সময়ই প্রথম ছিলো। যাইহোক, স্যাররা হয়তো সেই সময়ই আমার মধ্যে মেধাবী ছাত্রের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন। তাই সোবাহান স্যাররা নিয়মিত আমার স্কুলের বাইরেও খবর রাখতেন। কাকাদের সাথে আমাদের ঝগড়ার বিষয়টিও হয়তো তাদের কানে যেতো। একদিন সোবাহান স্যারদের বাড়িতে টিভি দেখতে গেলে স্যার আমাকে বলেন, “তুই আমাদের এখানে টিভি দেখতে আসিস।”
স্যারদের বাড়িতেও অনেক টিভি দেখেছি। সেখানেও বিদ্যুৎ ছিলো না। ব্যাটারিতে দেখতাম। শুনেছি শুক্রবার বাংলা ছায়াছবি দেখার সময় কখনো কখনো স্যারের মেয়ে রুনাসহ সমবয়সী অন্যরা বাইরের অনেকের কাছ থেকে দুই এক টাকা করে নিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতো। আমার বাল্যবন্ধু শাহিনুর বাল্যকালের টিভি দেখার প্রসঙ্গ উঠলেই এটি বলে। সেও দুই একবার টিকিট কেটে ঢুকেছে। আমি কখনো টিকিট কেটে ঢুকেছি বলে মনে হয় না। আর টিকিট কেটে ঢুকার টাকাও আমার ছিলো না। টিকিটের টাকা যোগাড় করবার জন্য অনেকেই বাড়ি থেকে প্যান্টের পকেটে বা লুঙ্গিতে করে চাল নিয়ে এনে দোকানে বিক্রি করতো। আমার সে অভ্যাস ছিলো না। তবে বোধ হয় হাই স্কুলের নিম্ন শ্রেণিতে পড়ার সময় হাই স্কুলের পাশের এক বাড়িতে ভিসিআর দেখার সময় এ অভ্যাসের ব্যতিক্রম হয়েছিল।
আমাদের সে সময়ের সমবয়সী সকল ছেলের টিভি দেখার অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। গতকালই আমার লেখার প্রথম পর্ব দেখে আমার সিনিয়র ওবায়দুর রহমান ভাই কল দিয়ে তার একটি ঘটনার কথা শেয়ার করেন। ওবায়দুর রহমান ভাই সম্পর্কে কিছু কথা বলি- তিনি হাই স্কুলে আমার দুই বছরের সিনিয়র কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাচমেট। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বিশ্ববিদ্যালয়েই। তিনি ফিন্যান্স বিভাগে পড়তেন আর আমি একাউন্টিংয়ে। খুবই স্মৃতিকাতুরে এবং আমুদে লোক। গ্রামের প্রতি অসীম টান তার। এই টানের কারণেই তিনি ইয়ার ড্রপ দিয়েছিলেন মনে হয়। আমরা এখন একসাথে একটি সামাজিক সংগঠন করি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই- জাগো সমাজকল্যাণ সংগঠন। তিনি এ সংগঠনের সভাপতি আর আমি সম্পাদক। একটি ব্যবসায়িক সংগঠনও দাঁড় করিয়েছিলাম আরও কয়েকজন মিলে কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটি অবসায়নের পথে। তিনি এখন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে খুলনায় কর্মরত আছেন। সম্প্রতি একটি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন- সবার দোয়া প্রত্যাশী।
ছোটবেলায় ওবায়দুর ভাইয়ের সাথে তাদের পাড়ার আব্দুল মান্নানের (ডাকনাম ট্যাট্টেরে) খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। হাই স্কুল সংলগ্ন পুকুরের উত্তর পাশে ছিলো ট্যাট্টেরেদের বাড়ি (এখন আর নেই) আর দক্ষিণ পাশে ওবায়দুর ভাইদের বাড়ি। মাঝে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। ফলে তাদের মধ্যে সে সময়ে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এলাকার বিভিন্ন ব্যাপারে ট্যাট্টেরেই তাকে খোঁজ-খবর দিতো। একদিন সন্ধ্যার পরে ওবায়দুর ভাই তার বাবার সাথে বসে লেখাপড়া করছিলেন। এক ফাঁকে ট্যাট্টেরে তার কানে কানে বলে গেলো ভিসিআর আসছে। কোথায় আসছে এটি হয়তো সে বলেছিল কিন্তু বাবা সামনে থাকায় এটি আর ওবায়দুর ভাই’র খেয়াল নেই। সেও বলেই সবেগে প্রস্থান করে। শুধু একটা কথাই মনে ছিলো তার- ভিসিআর। এটি শুনামাত্র তিনি উশখুশ করেন উঠার জন্য। রওনা দেন ভিসিআর দেখার জন্য। কিন্তু কোথায় যাবেন সে ঠিকানা তার জানা ছিলো না। ভাবলেন আশেপাশেই হবে হয়তো। রাত্রি তখন আটটা নয়টা হবে। প্রথমে গেলেন তার বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে উত্তর দিকে নদীর পাড়ে মালেপাড়ায়। কিন্তু সেখানে ভিসিআরের কোন নাম গন্ধ পেলেন না। তখন ভাবলেন হয়তো চরপাড়ায় আসছে। সেখান থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে একা একা হেঁটে রওনা দিলেন চরপাড়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানেও কোন হদিস পেলেন না। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন বাড়ির কাছে। কিশোর মন তখনো অনবরত খুঁজে চলেছে ভিসিআর কোথায় দেখানো হচ্ছে। এই সময় দিঘীর পাড়ের উঁচু স্থান থেকে তিনি দেখতে পেলেন দূরে বকশীপুরের দিকে মাঠের মধ্য থেকে একটি নীল আলো ভেসে আসছে। তিনি ভাবলেন এটিই হয়তো ভিসিআরের আলো- এটিই ভিসিআর দেখার জায়গা। আবার রওনা দিলেন- ভিসিআর তাকে দেখতেই হবে। তখন ড. কাজী মোতাহার হোসেন কলেজ সংলগ্ন এই পাড়াতে দুই একটা বাড়ি ছাড়া তেমন বাড়ি ঘর ছিলো না। আর আলোটি যেদিক থেকে আসছিল গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। তখনকার গোরস্থান ছিলো জঙ্গলে ভরা। এতো পরিষ্কার ছিলো না। দিনের বেলাতেই আমরা গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা ভয়ে তাকানোই সাহস করতাম না। এই ভয়ার্ত পরিবেশে আধা জোছনার আলোয় কিশোর ওবায়দুর একা একা এগিয়ে চললো নীল আলোর দিকে। ভরসা একটাই- সামনেই তো ভিসিআর, সামনেই তো অনেক মানুষ। কিন্তু কাছে পৌঁছেই তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। এটি তো ভিসিআরের আলো নয়- স্যালো মেশিনের মাথায় লাঠির সাথে বাঁধা লাইটের আলো। মুহুর্তে তার সকল আশা ভরসা মাটিতে মিশে গেলো। ভয়ে আতঙ্কে তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো। ভিসিআর তো দেখা হলোই না। এখন সে এই বিপদ-সঙ্কুল ভয়ার্ত পথ পাড়ি দিয়ে কিভাবে বাড়িতে পৌছাবে- এই ভেবে তার জান ঠোঁটের মাথায় চলে এলো। রাত্রি তখন দশটা এগারোটা হবে। বুকের মধ্যে কে যেন অনবরত ঢেঁকি পাড়াতে লাগলো। ধুপধাপ ধুপধাপ আওয়াজে ছোট্ট বুকটা বারবার প্রকম্পিত হতে লাগলো। সামান্য একটু সাহস সঞ্চয় করে কোন দিকে না তাকিয়ে জোরে দুই একটি গানের প্রথম কথাগুলো গাইতে গাইতে তিনি এক দৌঁড়ে আবার ফিরে এলেন দিঘীর পাড়ে। দিঘীর ওপাড়েই তার বাড়ি। কিন্তু তখনো একটি পরীক্ষা তার বাকি। স্কুলের পেছন দিয়ে আর দিঘীর পাড় দিয়েই তাদের বাড়িতে যেতে হতো। ওই পথটিও এখনকার মতো পরিষ্কার, খোলামেলা ছিলো না। চলতিপথে বড় বড় গাছের সমারোহ, পরিত্যক্ত একটি ময়লাযুক্ত পাকা পায়খানা আর ঝোপঝাড়ের মিশেলে চলার পথটা ছিলো খুবই সঙ্কীর্ণ। রাতের বেলায় বড় বড় পাখির চিৎকার চেঁচামেচি স্কুলের বাউন্ডারির ভেতরে প্রতিধ্বনি হয়ে ভয়ার্ত এক ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করতো। আবারো একই কায়দায় জানটাকে হাতের উপর নিয়ে এক দৌঁড়ে ঘরের বারান্দায় পৌঁছলে তিনি সে যাত্রায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
এমনই টুকরো টুকরো রোমাঞ্চকর গল্পে ঠাসা ছিলো আমাদের ছেলেবেলার টেলিভিশন, ভিসিআর দেখার দিনগুলো। বর্তমান প্রজন্ম কী এসবের স্বাদ কোনদিন পাবে!!
লেখক – শিপন আলম- (৩৪তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত) – প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ
করটিয়া, টাঙ্গাইল।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়