“ছেলেবেলার টেলিভিশন দেখা”(প্রথম পর্ব) : লেখক- শিপন আলম

- Update Time : ০৩:১৯:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৩
- / ১৪৮ Time View

রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম দুরন্ত পদ্মার পাড়ে বেড়ে ওঠা আমি আমার ছেলেবেলার নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে কিছুটা লিখবো। কিন্তু মনের মধ্যে নানা সংকোচ উঁকি দেওয়ায় বারবারই পিছিয়ে এসেছি। মনে হয়েছে এখন এসব থাক, পরে দেখা যাবে, এখনো সময় হয়নি ইত্যাদি নানা কথা। তবে লেখক হয়ে উঠতে হলে এসব দ্বিধা সংকোচ থেকে মুক্তি চাই। মনের সব কথা কালো হরফের অক্ষরে সহজ-সরল ও সাবলীলভাবে লেখার ক্ষমতা ও সাহস না থাকলে কোনদিনই কেউ লেখক হয়ে উঠতে পারবে না। আমার এ প্রবন্ধটি লেখবার পশ্চাতে যে মনীষীর জীবন দর্শন প্রেরণা যুগিয়েছে তিনি হচ্ছেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁর রচিত ‘স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বৃদ্ধ বয়সে লিখতে গিয়ে তিনি বারবার ছেলেবেলার বিভিন্ন ঘটনা ভুলে যাওয়ার দিকে আলোকপাত করে অনুশোচনায় দগ্ধীভূত হয়েছেন। তাঁর মতো অনুশোচনা যাতে আমাকেও পেয়ে না বসে সেই প্রেরণা থেকেই অল্প কিছু লেখার প্রচেষ্টা।
আমার ছেলেবেলায় যত মজার, দুরন্ত ও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর মধ্যে এই টেলিভিশন দেখাটা অন্যতম অনুষঙ্গ। ভাবতে অবাক লাগে, যে টেলিভিশন এখন আমার বাসায়, গ্রামের বাড়িতে শোভা পাচ্ছে সেই টেলিভিশন এর প্রতি এক সময় কত আকুল ছিলাম, কত উন্মুখ ছিলাম।
আমাদের বাড়িটি ছিলো রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার হাবাসপুর ইউনিয়নের শেষপ্রান্তে মাছপাড়া নামে ছোট একটি গ্রামে। বলতে গেলে একেবারে পদ্মার পাড়ে। কেননা আমাদের বাড়ির পরে নদীর দিকে শুধু একটি বাড়িই ছিলো- এরপর ছোট মাঠ তারপর ছোট নদী (আমরা এটিকে ছোট গাঙ বা কোল বলতাম), আবার বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ তারপর বড় নদী। বাড়িটি ছিলো বললাম এই কারণে যে, ২০০৯ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালে আমাদের বাড়িটি পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। এখন ঠিকানা হয়েছে হাবাসপুর ঈদগাহ ময়দানের উত্তর পার্শ্বে। আমাদের বাড়ির কয়েক ঘর পরেই বাহাদুরপুর ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল (এটি ছিলো বকশীপুর গ্রাম)।
পাংশা-সেনগ্রাম পাকা রাস্তা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার উত্তরে ছিলো আমাদের বাড়ি। এই আধা কিলোমিটারের প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলো, আমাদের বাড়ি দ্বিতীয় অর্ধেকে থাকায় আমরাসহ বাকিরা বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। তাই টেলিভিশন দেখা নিয়ে আমাদের পুরো শৈশব, কৈশোরের কিয়দংশ নানা চ্যালেঞ্জ, বাধা আর রোমাঞ্চে ভরা ছিলো। রচনাটি পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে বলে রাখি, সনদপত্র অনুযায়ী আমার জন্মসাল ১৯৯০ হলেও প্রকৃত জন্মসাল ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি হবে হয়তো।
ছেলেবেলার টেলিভিশন দর্শন যাত্রাটা কবে শুরু হয়েছিলো, কিভাবে শুরু হয়েছিলো তা বলতে পারবো না। শুধু একটা ঘটনা মনে আছে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহানায়ক সালমান শাহ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন অনেকের সাথে আমিও তার এই মৃত্যুর ঘটনাটি দেখবার বা জানবার জন্য যাদের বাড়িতে টিভি ছিলো তাদের বাড়িতে ছুটাছুটি করেছিলাম। আমার মনে আছে প্রথমে বকশীপুরের মণ্ডলপাড়ায় সম্ভবত বাদশা ভাইদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় সেখান থেকে জানতে পারলাম প্রায় এক কিলোমিটার দূরে হাবাসপুর বাজারের পাশে নিজাম আঙ্কেলদের বাড়িতে ব্যাটারি আছে। ফলে ত্বরিত গতিতে সেখানে আসলে দেখি লোকে লোকারণ্য। একেবারে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছোট মানুষ হওয়ায় কোনমতো এর, ওর কোমরের নিচ দিয়ে হালকা হালকা টিভির স্ক্রিন দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ পরে রাত আটটা বা নয়টার খবরে সালমান শাহ’র মৃত্যুর খবরে একটু ভিডিও দেখালো। একালের পাঠকদের বলে রাখি তখন কিন্তু বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেল ছিলো না। যাইহোক, ভিডিওতে দেখলাম সালমান শাহ’র লাশ কবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বা কবরে নামাচ্ছে। একটু পরেই ভিডিও বন্ধ করে দিয়ে খবর উপস্থাপিকা অন্য খবরে চলে গেলে উপস্থিত দর্শক তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লো। অনেকেই উপস্থাপিকাকে গালিগালাজ করতে লাগলো। কেউ কেউ বললো আবার দেখাবে। আমি কিছু সময় অপেক্ষা করে নাকি তখনই বাড়ি চলে এলাম তা বলতে পারবো না।
১৯৯৮ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের আগে আমার কাকা আব্দুল কাদের মণ্ডল একটি টেলিভিশন কিনলেন। তখন সব টেলিভিশন সাদা-কালো ছিলো। রঙিন টেলিভিশন ছিলো কিনা বলতে পারবো না। কেউ কেউ একটু রঙিন ভাব নিয়ে আসার জন্য টেলিভিশনের পর্দার উপরে একটু আকাশী ধরণের পলিথিন মুড়িয়ে দিতেন। সে যাইহোক, আমাদের বাবা চাচাদের মধ্যে কাকাই একটু স্বচ্ছল ছিলেন। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তার ঘরখানার ডোয়াতেই (ঘরের চারপাশের ভিত্তি) ইটের গাঁথুনি ছিল এবং তার উপর টিনের বেড়া ছিলো। তাছাড়া বাকি সবার ঘরই ছিলো কাঁচা। তো এই বিশ্বকাপের অন্য সব খেলার কথা মনে নেই শুধু মনে আছে একটা খেলায় এক গোলকিপার প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারের আঘাতে আহত হন। তাকে সুস্থ করার জন্য তার পেছনে ধোঁয়ার মতো এক ধরণের পাউডার মারা হয়। পরে জেনেছি সেটি ফাইনাল খেলা ছিলো এবং গোলকিপারটি ছিলো ফ্রান্সের।
আমাদের টেলিভিশন দেখার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহুর্তগুলো লুকিয়ে আছে মেগা সিরিয়াল আলিফ লায়লা দেখার মধ্যে। প্রতি শুক্রবার রাত আটটার খবরের পরে এটি দেখানো হতো। সপ্তাহের সাতটা দিন আমরা হাপিত্যেশ করতাম কবে শুক্রবার আসবে, কখন পরের পর্বটা দেখবো। দুই চারজন মিলে আলোচনাও করতাম এরপরের পর্বে কী হবে, সিনবাদ বা তালিবের কী হবে, কেহেরমানের হাত থেকে সে রক্ষা পাবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি প্রথম সিনবাদের পুরোটা দেখেছি বলে মনে হয় না, তবে এরপরের সিনবাদ-তাইবা-ডোবার-ফিরোজ, তালিব এদের সিরিজগুলো দেখেছি। টেলিভিশন না থাকায় কী মাত্রায় যে ভোগান্তির শিকার হয়েছিলাম আমরা তা বলে বুঝাতে পারবো না। আমাদের গ্রামের পাশে ছিলো মিয়াপাড়া ও মির্জাপাড়া। তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকায় টেলিভিশনও ছিলো। তারা বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী সবাই মিলে ঘরের ভেতরে টেলিভিশন দেখতো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জায়গা হতো ঘরের জানালায়। অনেকটা নির্লজ্জ, বেহায়ার মতোই আমরা সেই ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে টিভি দেখতাম। পোলাপান বেশি হলে বা হট্টগোল হলে তারা বা তাদের বাড়ির দুই একজন ভাবওয়ালা বড় ভাই জানালা বন্ধ করে দিতো। ফলে আমাদের টিভি দেখা তখন বন্ধ হয়ে যেতো। আমরাও কম ছেড়ে দিতাম না। কেউ কেউ দরজা-জানালায় ধাক্কাধাক্কি করতো, টিনের চালে ঢিল ছুঁড়ে মারতো ইত্যাদি। অনেক সময় বাড়ির বড় ভাইয়েরা ছুটে এসে তাড়া করতো আমাদের। অনেক চেষ্টা করেও যখন কাজ হতো না তখন আমরাও ক্ষান্ত দিতাম।
এই আলিফ লায়লার গান যখন কানে ভেসে আসতো তখন একেবারে উন্মাদ হয়ে যেতাম। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। কোন বাড়িতে কোথায় গিয়ে একটু আলিফ লায়লা দেখবো তার জন্য পাগলের মতো এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটাছুটি করতাম। সবচেয়ে বেশি দেখেছি মনে হয় বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ভাসাই মালের বাড়িতে। তিনি তখন মেম্বার ছিলেন। তিনি উঠোনে টেলিভিশন সেট করতেন। ফলে একটু শান্তিমতো সবাই দেখতে পেতো। রাস্তা দিয়ে বা মাঠের মধ্য দিয়ে জোছনার আলোয় পথ চলতে চলতে আমরা সেখানে যেতাম আবার ফিরে আসতাম। মাঠ দিয়ে আসার সময় চাঁদের দিকে তাকালে মনে হতো সেও আমাদের সাথে আসছে, আমাদের সাথে যাচ্ছে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। আমার সাড়ে চার বছরে বড় ছেলেটিকে নিয়ে বের হলে সেও এখন একই কথা বলে। বলে, “বাবা, আমরা যেখানে যেখানে যাচ্ছি চাঁদটিও আমাদের সাথে সেখানে সেখানে যাচ্ছি।” মূহুর্তে চলে যাই আমার শৈশবের অবুঝ সেই দিনগুলোতে।
ছোটবেলায় অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে বেড়ে উঠেছি আমি। আর পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ায় সাংসারিক দায়িত্ব থেকেও এক প্রকার মুক্ত ছিলাম। তাই টেলিভিশন দেখায় তেমন কোন বাধা ছিলো না আমার। শুধু মা মাঝে মাঝে বলতো, “পাঁচ ছাওয়ালের কোনোডাই টিভি দেহে না, জ্বালা হয়ছে ছোট দুডের নিয়ে” (আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই)। কিন্তু আমরা ওসব গায়ে মাখতাম না। আশেপাশের সব বাড়িতেই টেলিভিশন দেখতাম আমরা। যখন যেখানে সুযোগ পাওয়া যায় সেখানেই যেতাম। দুই টাকা বা এক টাকার টিকিট কেটেও টেলিভিশন দেখতাম আমরা। সে এক মধুর অভিজ্ঞতা। সেসব আজ কল্পকাহিনীর মতো শুনায় বর্তমান শিশু কিশোরদের কাছে।
লেখক- শিপন আলম, (৩৪তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত), প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়