“১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” : লেখক – শারমিন রেজা লোটাস
- Update Time : ০৯:০৩:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৩
- / ৩১৩ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
হঠাৎ যদি পুরো বিশ্বের সব শ্রমিক অদৃশ্য হয়ে যায় তবে বিশ্ব থমকে যাবে! আসুন আমরা
সকলেই এটি অনুধাবন করি এবং আসুন শ্রমিকদের সম্মান করি এই দুর্দান্ত মানুষরাই আমাদের
বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যায় ১ মে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় মে দিবস। এই দিনটির ইতিহাসের বহু
দিকই অনেকের জানা নেই। জেনে নিন, তেমনই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মে দিবস। প্রতি
বছর ১ মে পালন করা হয় এই দিনটি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবেও চিহ্নিত এই দিনটির
ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই। দেখে নেওয়া যাক, কেন পালন করা হয় দিনটি।
কঠিন পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। সুতরাং লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য নিজের সেরাটা দেওয়ার
চেষ্টা কর। মহান মে দিবসে এই কথাটা আরও একবার মনে করিয়ে দিলাম।
মে দিবস ছুটির দিন। এনজয় কর। কিšদ মে দিবসের ইতিহাস বা মে দিবসের তাৎপর্য ভুলে গেলে চলবে না।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহিদদের
আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে
মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা
নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও
পুলিশ নিহত হয়। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ-বের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয়
আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে থেকে শিকাগো
প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে ১৮৯১
খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর পরপরই
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে
অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে
দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য
বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক
দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে
“শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে
‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে
মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা
কার্যকর হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবি
জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসাবে বেছে নেয়। কোনো কোনো স্থানে শিকাগোর হে
মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে।
১৮৮৬ সালের সেই রক্তাক্ত মে দিবসের পর ১৩৬ বছর পার হয়েছে। সেদিনে আমেরিকার
শিকাগো শহরের শিল্পাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে যে সংগ্রাম গড়ে
তুলেছিল এতে অসংখ্য শ্রমিককে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, অনেককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিতে
ঝুলতে হয়েছে। তাদের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রমিকের ৮ ঘন্টা কাজের
দাবি। যে কারণে সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের কাছে মে দিবস একটি ঐতিহাসিক দিবসে
পরিণত হয়। সে সত্যটি আজ চাপা পড়ে গেছে। এখন আমাদের দেশেও ‘মে দিবস’ উদযাপিত
হচ্ছে। এমনকি এইদিনে কোনো কোনো জেলা শহরে আনন্দ-বিনোদন, ভালো খাওয়া-দাওয়া
হয়ে থাকে। কিšদ চেতনাকে ঝলসে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে না। এমনকি সংস্কৃতিকর্মীরা
কেমন যেন অসহায়, নির্জীব হয়ে পড়েছে। অবশ্য তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন নাকি নানা
ধরনের সুযোগ-সুবিধা, প্রলোভনের পেছনে দৌড়ে ক্লান্তসেটা অবশ্য বলা মুশকিল। সব যেন
এক ধোয়াশার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। শোষণের এই চক্রব্যুহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে
না। অথচ একসময় সুকুমার ভট্টাচার্যরা কি অদম্য সাহসে কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
হারাবার কিছু ভয় নেই শুধু শৃঙ্খল হবে হারা
জন কল্লোলে উত্তাল নদী মোহনায় দিশেহারা।।
তুফানে তুফানে তুলেছে আওয়াজ সইবো না
আজন্ম কাঁধে শোষণের চাকা বইবো না
এবার লড়াই, এবার লড়াইয়ে অস্ত্র শানিয়ে দাঁড়া।।
১৮৮৬ সালে আমেরিকাতে যে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সবটাই কিšদ
সেদিন শ্রমিকরাই করেনি। সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন বিপ-বী বুদ্ধিজীবীরা। তারা শ্রমিকের ওপর
ঘটে যাওয়া জুলুম-নির্যাতনকে অন্যায় মনে করতেন। যে কারণে তারা শ্রমিকদের সংগঠিত
করতে, তাদের চিন্তা-চেতনা এবং লড়াইটাকে একটি উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, শ্রেণি
সংগ্রামে রূপদান করে সমাজ বিপ-বের চেতনাকে জাগ্রত করতে তারা নিজের জীবনকে উৎসর্গ
করেছিলেন। শ্রমিকদের সাথে থেকে আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তাদেরকে সমাজ বিপ-বের
জন্য প্র¯দত করে তুলেছিলেন। বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষের চেতনার জায়গায় ভয়াবহ অবনতি
হয়েছে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও শ্রমিকদের চেতনা যে স্তরে ছিল এখন সে অবস্থানে নেই।
কারণ তারা আজ বিভ্রান্তহয়ে দ্বি-দলীয় রাজনীতির পুতুল হয়ে গেছে। তারা নির্দিষ্ট একটা
জায়গায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখান থেকে শ্রমিকদের বের করে এনে তাদের নিজস্ব শক্তিতে
দাঁড় করাতে হবে। তার জন্য ১৮৮৬ সালের মতো মানবতাবাদী, সংস্কৃতিসেবক ও
বুদ্ধিজীবীদেরকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কবি বলছেন ‘দেশে আজ কৃষ্ণপক্ষ’। কিšদ এই
কৃষ্ণপক্ষকে শুক্লপক্ষে পরিণত করার সংগ্রামই তো প্রতিতিশীল রাজনীতি।
কবি সময়কে আখ্যায়িত করেছেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’ দিয়ে। কিšদ এই সময়কে পাল্টে শুক্লপক্ষে
রূপায়িত করার দায়িত্ব আমাদের। কবিতাকে ইতিবাচক ব্যাখ্যা দেয়ার দায়িত্ব রাজনীতির।
হাত গুটিয়ে বসে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কিছু হবে না বলে বিলাপ না করে এগিয়ে
যাবার সংস্কৃতিকে মে দিবসের অঙ্গ করে তুলতে হবে। শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সাংস্কৃতিক
আন্দোলনের মেলবন্ধন রচনা করতে হবে। শ্রমিকের চেতনার জায়গাটাকে আরো তীক্ষ্ণধারালো করে তুলতে হবে। শ্রমিকের যে অধিকার আছে, তারা যে দাবি করতে পারে, তাদের
যে দাবি করার অধিকার রয়েছে সেই বোধ বা চেতনা জাগাতে হবে। তাদের মধ্যে এই বোধ
তৈরি এবং তাদের দুর্বলতম ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক
শ্রেণির যুথবদ্ধতায় শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। শ্রমজীবী মানুষকে
সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনায় জাগিয়ে তুলতে পারলে তারা আজকে যে মানবেতর জীবনযাপন করছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। দেশের অভ্যন্তরে আয় বৈষম্য যে রুদ্রমূর্তি
ধারণ করেছে, পুঁজিপতি মালিক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ধর্মব্যবসায়ীদের যে আঁতাত গড়ে
উঠেছে সেটাকে প্রতিহত করে একটি শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
প্রতিহত করা যাবে লুটপাটতন্ত্র, অন্যায়, নির্যাতন, সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতার
মতো সকল অশুভ শক্তিকে। শ্রমজীবী মানুষ আর শোষণমুক্তির আকাঙ্খাকে যারা লালন করেন
সেইসমস্তশিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিকের মিলিত চেষ্টায় মে দিবসের আকাঙ্খার
বাস্তবায়ন একদিন ঘটবেই। আর সেদিন আমরা শ্বেতকপোত আঁকা শান্তিপতাকা হাতে পা
রাখতে পারব মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজে। সেই প্রত্যাশায় অপেক্ষায় আছি সোনার
বাংলাদেশের। স্বাধিন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকার।
লেখক- শারমিন রেজা লোটাস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, রাজবাড়ী জেলা শাখা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়