একজন আত্মভোলা মানুষ- ড. কাজী মোতাহার হোসেন (পঞ্চম পর্ব) – লেখক: শিপন আলম
- Update Time : ০১:৪৮:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ৩৯ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
একবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাকে সভাপতি করা হয়। সভাপতির বক্তব্যে তিনি অবলীলাক্রমে নজরুলকে বাদ দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবন কাহিনী ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। এতে সভার উদ্যোক্তাগণ ও শ্রোতামণ্ডলী অবাক বনে যান। খানিকটা অস্বস্তিও বোধ করেন। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি একনাগাড়ে বলতেই থাকেন। এমন সময় তার কাছে ছোট টুকরা কাগজে চিরকুট পাঠানো হয়- ‘স্যার, এটা তো নজরুল জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, বলছেন রবিবাবু সম্পর্কে।’
তিনি চিরকুটের দিকে তাকালেন বটে কিন্তু থামলেন না। রবীন্দ্র নিয়ে আরও কিছু সময় আলোচনা শেষে ফিরে এলেন নজরুল প্রসঙ্গে। বললেন, ‘ আপনারা ভেবেছেন, নজরুল জন্মবার্ষিকীতে রবিঠাকুর সম্পর্কে বলে আমি ভুল করছি। বিষয়টি তা নয়, এই সভায় এ ধরণের বক্তব্যের প্রয়োজন ছিল। কেননা কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্র সাহিত্য অত্যধিক ভালবাসতেন।’
প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক প্রয়াত হেদায়েত হোসেন মোরশেদ তার ড. কাজী মোতাহার হোসেন- কে নিয়ে ‘দূর থেকে কাছে থেকে’ লেখায় কাজী সাহেবের আত্মভোলা স্বভাব নিয়ে বেশ কিছু চমৎকার ঘটনার অবতারণা করেছেন। তিনি এ সকল ঘটনাকে গল্প বলে আখ্যায়িত করেছেন কারণ তিনি নিজেও এগুলোর সাক্ষী নন। তবে কখনো সাংবাদিক হিসেবে কখনো দর্শক হিসেবে তাঁর রসময় আচরণের বহু ঘটনার সাক্ষী তিনি ছিলেন। আমার এ প্রবন্ধে তাই প্রাসঙ্গিকভাবেই কাজী সাহেবকে নিয়ে লেখা তার গল্পগুলো সমহিমায় স্থান পেলো।
একবার রবীন্দ্র জয়ন্তীর এক অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। তাঁর বক্তব্য দেওয়ার আগে অনেকেই রবীন্দ্র সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করেন সব অনুষ্ঠানেই যেমনটি হয়ে থাকে। কিন্তু কাজী সাহেব বক্তৃতা শুরু করেন হোমিওপ্যাথি ওষুধের গুণাগুণ বর্ণনার মাধ্যমে। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা ভাবলেন এটি হয়তো কাজী সাহেবের বক্তৃতার ভূমিকা। একটু পরেই হয়তো রবীন্দ্র আলোচনায় আসবেন। কিন্তু আয়োজকদের ভুল ভাঙলো যখন তারা দেখলেন তিনি শুধু হোমিওপ্যাথি নিয়েই একনাগাড়ে বক্তব্য প্রদান করে চলেছেন। তাই তারা কাজী সাহেবকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য স্লিপ পাঠালেন। স্লিপটির ওপর চোখ বুলিয়ে কাজী সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার একটু ভুল হয়ে গেছে। তবে আমি আর কথা বাড়াবো না। শুধু একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। কথাটি হলো, হোমিওপ্যাথি ঔষুধের উপরেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আস্থা ছিলো। কাজে কাজেই হোমিওপ্যাথি ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা যোগাযোগ রয়েছে।’
সঙ্গীতের প্রতি বাড়তি টান ছিল কাজী সাহেবের। আর তাই লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমেদের সাথে খুব সখ্যতা ছিল তাঁর। একবার পাকিস্তান কাউন্সিলের ঢাকা কেন্দ্রে আব্বাস উদ্দীন আহমেদের মৃত্যুর পরপরই তাঁর স্মরণে এক স্মৃতিসভার আয়োজন করা হয়। সভার একজন বিশেষ বক্তা হিসেবে কাজী সাহেব বক্তৃতা শুরু করেন, ‘আব্বাস উদ্দীন আহমেদ খুব রসিক মানুষ ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে খুব রসিকতা করতেন। আমার সঙ্গেও তিনি অনেক রসিকতা করতেন। তবে তিনি কবে রসিকতা করেছিলেন, কোথায় করেছিলেন, কি বলে রসিকতা করেছিলেন তা আমার কিছুই মনে নেই। কাজে কাজেই আমি সঠিক কিছু বলতে পারবো না। তবে এটা ঠিক, আব্বাস উদ্দীন খুব রসিক ছিলেন এবং আমার সঙ্গে বহুবার রসিকতা করেছেন….।’
হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ কর্তৃক উল্লেখিত ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের আরেকটি ঘটনা বেশ রসযুক্ত। সে সময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাকিস্তানি চলচ্চিত্রাভিনেতা, নাট্যশিল্পী ও টিভি উপস্থাপক জিয়া মহিউদ্দীন ঢাকায় আসেন। তৎকালীন পাকিস্তান কাউন্সিলের ঢাকা কেন্দ্রে তাঁর সম্মানে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কাজী সাহেবকে নিয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা হেদায়েত হোসেন মোরশেদের লেখনিতেই তুলে ধরা হলো:
সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। ড. কাজী মোতাহার হোসেন অনুষ্ঠানের সভাপতি কিংবা বিশেষ অতিথি। জিয়া মহিউদ্দীন এসে গেছেন। মিলনায়তন অতিথিতে ভরপুর। মতিঝিলের রাস্তায়ও দর্শকের বেজায় ভীড়। কিন্তু কাজী সাহেবের দেখা নাই। পাকিস্তান কাউন্সিলের তখনকার দুই কর্মকর্তা মিসেস নাজমা আতাহার ও ইকবাল বাহার চৌধুরী উৎকণ্ঠা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের মিনিট পনের পর কাজী সাহেব এলেন। এসেই বললেন,”দারুন তাড়া আছে, তাঁকে আগেভাগেই ছেড়ে দিতে হবে।” অনুষ্ঠান ঘোষক ইকবাল বাহার চৌধুরী অনুষ্ঠান শুরু করলেন। ইংরেজিতে। স্বাগত ভাষণ দিলেন মিসেস নাজমা আতাহার। ইংরেজিতে। এরপর দাঁড়ালেন কাজী সাহেব। আমি সেই অনুষ্ঠানটি কভার করার জন্যে পত্রিকার এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। কাজী সাহেব তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন বাংলায়। বললেন, “আমি কোন নেতা নই। নেতার সঙ্গে অভি যোগ করলে দাঁড়ায় অভিনেতা। আমি সেই অভিনেতাও নই। আজকের অনুষ্ঠানের যিনি প্রধান আকর্ষণ তাঁকে আমি চিনি না। পত্রিকায় ছবি দেখেছি- সেই ছবিতে দাড়ি ছিলো। (উল্লেখ্য প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া ছায়াছবিতে ডক্টর আজিজ- এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জিয়া মহিউদ্দীন। মুখে দাড়ি ছিল। অর্থাৎ মেকআপ-এর ব্যাপার স্যাপার। পত্রিকায় তাঁর সেই শ্মশ্রুমণ্ডিত ছবিই ছাপা হতো।) কাজে কাজেই আমার জন্যে কিছু বলা খুব কঠিন। এসব ক্ষেত্রে কিছু ভালো ভালো কথা বলতে হয়। কী বলতে হয় তা আপনারা জানেন। পত্রিকায় সাংবাদিকরা নিজেদের মর্জিমতো বানিয়ে নেবেন। কাজে কাজেই আমি বলি কি, প্রবাদ আছে ঈসা পয়গম্বরের গর্দভ মক্কা ঘুরে এলেও যে গর্দভ সেই গর্দভই থাকে। তো ব্যাপার হলো আমি আর কী বলবো। আমি অনুষ্ঠানের জন্যে একটা কবিতা লিখে এনেছি। এখন আপনাদের সেই কবিতাটি শুনাবো।…. ” কাজী সাহেবের বক্তৃতা শুনে সবাই তখন হাসছেন। জিয়া মহিউদ্দীন কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি মনে করলেন, সবাই যখন হাসছে বোধহয় কোন আনন্দদায়ক কথাবার্তাই বলছেন কাজী সাহেব। বাংলা বক্তৃতা কিছুই না বুঝে জিয়া মহিউদ্দীনও অতিথিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানে হেসে যাচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কাজী সাহেব তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে একটি কাগজ বের করলেন। নেড়েচেড়ে দেখলেন। বললেন, “আমি ভুল করে কবিতাটি আনি নি। তবে স্ট্যাটিসটিক্স- এর দু’একটি তথ্য এই কাগজটিতে রয়েছে। আমি আপনাদের তাই শোনাচ্ছি। তারপর কাজী সাহেব স্ট্যাটিসটিক্স- এর তথ্য শুনিয়ে বক্তৃতা শেষ করলেন।
একবার নাকি তিনি মশারি গায়ে দিয়ে ক্লাসে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর অষ্টম সন্তান ‘মাসুদ রানা’ খ্যাত লেখক সদ্য প্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর ‘ভালমানুষ আব্বু’ রচনায় এটিকে বানোয়াট গল্প হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গভীর আত্মমগ্নতার কারণে তিনি কখনো কখনো নিজ সন্তানদেরও ভুলে যেতেন। এরকমই একটি ঘটনা প্রচলিত আছে তাঁর কনিষ্ঠ ছেলেকে নিয়ে। তাঁর নাম কাজী মাহবুব হোসেন যাকে কাজী সাহেব আদর করে নূরু নামে ডাকতেন। তিনি বেশ ভালো দাবা খেলতেন। একদিন তিনি তাঁর কনিষ্ঠ এই ছেলেকে বললেন, “আমার এক ছেলে এক সময় ভালো দাবা খেলতো। তার নাম হলো নূরু। সে কি বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে?”
শেষ বয়সে অনেককেই চিনতে পারতেন না ঠিকমতো। একবার কাজী আনোয়ার হোসেনকে ঘরের মধ্যে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ এই যে, সাহেব, আপনারা যে ঘরের মধ্যে ঘুরাঘুরি করছেন, এদিকে ওদিকে যাচ্ছেন- বাড়িটা তো আমার!
লেখক: শিপন আলম, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ, টাঙ্গাইল।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়