“আদু ভাই, শিক্ষা ক্যাডার ও পদোন্নতি” : লেখক – শিপন আলম

- Update Time : ০৮:৪৬:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
- / ২২৩ Time View

রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
বাংলা সাহিত্যে যতগুলো জনপ্রিয় ও পরিচিত চরিত্র আছে সেগুলোর মধ্যে আদু ভাই চরিত্রটি বহুবিধ কারণে সবার নিকট খুবই সুপরিচিত। সুসাহিত্য আর বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধসম্পন্ন সাহিত্য রচনার জন্য যিনি সর্বজন স্বীকৃত সেই আবুল মনসুর আহমদ তাঁর তীক্ষ্ণ হাস্যরসবোধ আর করুণ রসের আরেক দফা নজীর উপস্থাপন করেছেন তাঁর ‘আদু ভাই’ ছোটগল্পটিতে। এই চরিত্রটি রচনার কাল ও স্থান অতিক্রম করে সর্বকালের ও সর্বক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় তা এখন একটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। তাই তো আমরা মাঝে মাঝেই অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনি, ঠিকমতো লেখাপড়া করিস না ক্যান, আদু ভাই হয়ে থাকবি নাকি? কিংবা দুই এক বছর এক ক্লাসে থাকলেই শিক্ষকরা ও সহপাঠীরা ওই শিক্ষার্থীকে আদু ভাই নামে সম্বোধন করে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২৬ টি ক্যাডারের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডার একটি। ১৯৮০ সালের ক্যাডার কম্পোজিশন অ্যাক্টে’র মাধ্যমে এ ক্যাডারটি সৃষ্টি হলেও শুরু থেকেই এটি সঠিক সময়ে পদোন্নতি না হওয়া, বদলির অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বদলি নীতি অনুসরণ না করা, একের পর এক প্রশাসনিক পদগুলো হারানো, কর্মকর্তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত করা, ধীরে ধীরে সবাইকে শুধু শিক্ষাদান কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলা, গবেষণা ও দক্ষতা ভিত্তিক পদোন্নতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করা, যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত। বহুবিধ সমস্যায় নিপতিত এ ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তাদের তাই আদু ভাইয়ের মতো এখন একটিই চাওয়া- পদোন্নতি।
আদু ভাই যেমন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ক্লাস সেভেনেই থাকতেন, তিনি কবে ওই ক্লাসে উঠেছেন তা যেমন তার শিক্ষকগণ ও ঐ স্কুলের ছাত্ররা জানতো না; আমাদের এই শিক্ষা ক্যাডারেও তেমনি অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা কতদিন ধরে প্রভাষক পদে আছেন তা তাদের পরিবার পরিজন ও অন্যরা জানেন না। আদু ভাইয়ের অনেক সহপাঠী লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষক হিসেবে তার বিদ্যালয়ে যোগদান করলেও আদু ভাই যেমন আদু ভাই-ই রয়ে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনি এসব প্রভাষকদের অনেক ছাত্র লেখাপড়া শেষ করে বিসিএসের মাধ্যমে ওই কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে দেখেন তাদের সেই প্রিয় প্রভাষক স্যারটি এখনো আদু প্রভাষক হিসেবেই রয়ে গিয়েছেন। আদু ভাই যেমন তার শ্রেণির পুরাতন ব্ল্যাকবোর্ডের মতোই নিতান্ত অবিচ্ছেদ্য এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক অঙ্গে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনি এসব প্রভাষকগণও এ পদের সাথে সুপার গ্লু আঠার মতো লেগে গিয়েছেন। তারা ছাড়া এ পদটি বেমানান, বিশ্রী, কদর্য আর আভিজাত্যহীন।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানলাম, এক যুগের অধিক সময় ধরে প্রভাষক পদের আসন অলঙ্কার করে আছেন আমাদের ২৮তম বিসিএসের অনেক ক্যাডার কর্মকর্তা। ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর ক্যাডারের তকমা নিয়ে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে তাদের অভিষেক ঘটেছিল। অথচ এই এক যুগে দেশে বিদেশে ঘটে গিয়েছে কতো ঘটনা! পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় গড়িয়েছে কতো জল! কতো নদী এর মধ্যে হারিয়েছে তাদের যৌবন, পরিণত হয়েছে খা খা শুষ্ক মরুতে! কতো যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হয়ে আবার থেমেও গিয়েছে, কতো সরকার পরিবর্তন হয়ে নতুন সরকার এসেছে, দেশের কতো সূচক পরিবর্তন হয়েছে! পরিবর্তন হয় নি শুধু বনসাই সদৃশ শিক্ষা ক্যাডারের এসব কর্মকর্তাদের ভাগ্যের। পদোন্নতির দেখা মেলেনি একটিবারের জন্যও।
আদু ভাই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ক্লাস সিক্সও পার করতে পেরেছিলেন কিন্তু এসব কর্মকর্তাগণ এখনো চাকরি জীবনের প্রাথমিকের গণ্ডিই পার হতে পারেন নি। অথচ এই সময়ের মধ্যে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ব্যাচমেটগণ সহকারী কমিশনার থেকে সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও, এডিসি, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদায়ন পেয়েছেন; এখন অপেক্ষা করছেন উপ-সচিব বা ডিসি হওয়ার পাইপলাইনে। ২৮তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ ইতোমধ্যে উপ-সচিব পদেও পদায়ন পেয়েছেন। প্রায় একই সময়ে যোগদান করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এখন শিক্ষকদের সর্বোচ্চ পদ অধ্যাপক,সহযোগী অধ্যাপক পদে আসীন হয়েছেন। অন্য অনেক ক্যাডার সদস্যগণও চাকরিতে কয়েকবার পদোন্নতি পেয়েছেন। শুধু থেমে আছে শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি। শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া এখন যেন সমার্থক। মোশাররফ করিমের ফুটবল নাটকের মতো এসব কর্মকর্তাদের জীবনে এখন একটিই চাওয়া সেটি হচ্ছে একটি গোল দেওয়া। আর সেই গোল হচ্ছে পরম আরাধ্য পদোন্নতির বন্ধ্যাত্ব ঘোচানো।
অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে এসব ক্যাডার কর্মকর্তাগণ আদু ভাইয়ের মত ‘সবুরে মেওয়া ফলা’র কথা বলে নিজেরাই নিজেদের প্রতিনিয়ত সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। আদু ভাই যেমন জ্ঞানলাভের জন্য স্কুলে পড়তেন, প্রমোশন লাভের জন্য না। ঠিক তেমনি শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকগণও জ্ঞান বিতরণের জন্য চাকরি করেন, প্রমোশনের মতো মামুলি বিষয়ের জন্য চাকরি করেন না। আদু ভাইয়ের মতোই তাদের দর্শন- ‘আজ হোক, কাল হোক, প্রমোশন আমাকে দিতেই হবে। তবে হ্যাঁ, উন্নতি আস্তে আস্তে হওয়াই ভালো। যে গাছ লকলক করে বেড়েছে, সামান্য বাতাসেই তার ডগা ভেঙেছে।’
আদু ভাই যেমন মনে করতেন ‘যেদিন তিনি সব সাবজেক্টে পাকা হবেন, প্রমোশন সেদিন তাঁর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’ আমাদের শিক্ষা ক্যাডারগণও একদিন জ্ঞানে-গরীমায়, বিদ্যা-বুদ্ধিতে, অর্থ-ক্ষমতায় আর প্রশাসনিক দক্ষতায় পাকা হয়ে উঠলে সেদিন প্রমোশন তাদের কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ‘সে শুভদিন যে একদিন আসবেই’ সে সম্পর্কে আদুভাই’র যেমন ‘এতটুকু সন্দেহ ছিল না’ তেমনি আমাদের শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যগণেরও এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমরা শুধু শিক্ষার্থীদের মনেই আশা সঞ্চার করি না নিজেরাও আশান্বিত মানুষ, আমরা শুধু শিক্ষার্থীদেরই স্বপ্ন দেখাই না, নিজেরাও স্বপ্নবাজ মানুষ।
‘আদুভাইকে কেউ কখনো পিছনের বেঞ্চিতে বসতে দেখে নি। সামনের বেঞ্চিতে বসে তিনি শিক্ষকদের প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, হা করে গিলতেন, মাথা নাড়তেন ও প্রয়োজনমতো নোট করতেন। খাতার সংখ্যা ও সাইজে আদুভাই ছিলেন ক্লাসের একজন অন্যতম ভাল ছাত্র।’
আমরাও আমাদের পদোন্নতির বিষয়টিকে প্রতিনিয়িত বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সমিতি, ব্যাচভিত্তিক ফোরাম, শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটি, স্বাধীনতা বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) পরিষদ প্রভৃতির নির্বাচনী ইশতেহারে ও দাবি দাওয়ায় সামনের দিকেই রাখি। অন্য ক্যাডারগুলোর পদোন্নতি হলে মনোযোগ দিয়ে তা দেখি, হা করে গিলি, মাথা নাড়াই ও প্রমাণ হিসেবে নোট করে রাখি। অন্য ২৫ ক্যাডারের ৬ষ্ঠ গ্রেড প্রাপ্তির ও পদোন্নতির নোট আমাদের রাখতে হয়। কারণ প্রমাণ না দেখালে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন না যে আমরা ৬ষ্ঠ গ্রেড বা পদোন্নতি আদৌ পাই নি। নোটের সংখ্যা ও সাইজে আমরাই ক্যাডারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য।
আদু ভাই যেমন স্কুলে সবার আগে পৌছানোয় প্রথম ছিলেন, শিক্ষক কি ছাত্র কেউ তাকে কোনদিন হারাতে পারে নি। আমরাও তেমনি এমন একটি পেশায় আছি যে পেশা সবার চেয়ে মহান। মহান পেশার দিক থেকে কেউ আমাদের আজ পর্যন্ত হারাতে পারে নি, ভবিষ্যতে পারবে বলেও মনে হয় না। অন্য কোন পেশার আগে এই মহান কথাটি বড় বেমানান। মহান পেশা বললেই সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই তোতাপাখির মতো নির্দ্বিধায় বলে ওঠে ‘শিক্ষকতা একটি মহান পেশা।’
আদু ভাই যেমন স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় বরাবরই দুটো পুরস্কার পেতেন- একটি, স্কুল কামাই না করার জন্য, অপরটি সচ্চরিত্রতার জন্য। আমরাও তেমনি দুইটি বিষয়ে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য- এক, মহান পেশার দিক থেকে অপরটি, দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেশে অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিগ্রস্ত পেশা হওয়ার দিক থেকে।
‘আদুভাই মনে করতেন, তিনি কবি ও বক্তা। স্কুলের সাপ্তাহিক সভায় তিনি বক্তৃতা ও স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। তাঁর কবিতা শুনে সবাই হাসত। সে হাসিতে আদুভাই লজ্জাবোধ করতেন না, নিরুৎসাহিতও হতেন না। বরঞ্চ তাকে তিনি প্রশংসা-সূচক হাসিই মনে করতেন। তাঁর উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যেত।’
আদু ভাইয়ের মত আমাদের শিক্ষা ক্যাডারে কম বেশি সবাই কবি ও বক্তা। ঢাকা শহরে কাকের যেমন অভাব নাই, তেমনি শিক্ষা ক্যাডারে কবির অভাব নাই। সুযোগ পাইলেই এরা ক্লাস নেওয়ার মতো বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন আর বক্তৃতার মাঝে নিজের রচিত দুই লাইন কবিতা আবৃত্তি করেন। এ কাব্যচর্চা শুনে তথাকথিত অভিজাত তকমা খচিত পেশাওয়ালারা মুখ টিপে হাসলেও আমরা এটিকে লজ্জার হাসি নয়, বরং প্রশংসার হাসিই মনে করি। আমরা আরো দ্বিগুণ উৎসাহে আমাদের কাব্যচর্চা চালিয়ে যাই। ‘কাজ নাই তো খই ভাজ’ এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান দশা। অথচ খই ভাজার মতো এদেশে জ্ঞানচর্চার যে শরীরী কোন মূল্য নাই সেকথা ভুলে যাই।
প্রথম বিবেচনা, দ্বিতীয় বিবেচনা, তৃতীয় বিবেচনা, বিশেষ বিবেচনা ইত্যাদি বিবেচনায় অন্য সবাই প্রমোশন পেয়ে পাশ করে বিবেচিত প্রমোশন প্রাপ্তদের সংখ্যা প্রকৃত প্রমোশন প্রাপ্তদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি হলেও আদু ভাই কোন বিবেচনাতেই প্রমোশন পান নি। অন্য ক্যাডারে শূণ্য পদের তুলনায় দুই গুণ তিন গুণ পদোন্নতি পেলেও আদু ভাইয়ের মতো আমাদের শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যগণ কোন বিবেচনাতেই পদোন্নতি পান না। আদু ভাই যেমন প্রমোশনের জন্য আবেগ ধরে রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অনুজ সহপাঠীর পা ধরে কান্নাকাটি করেছিলেন। আমাদেরও উচিৎ অগ্রজ, অনুজ, কর্তা, কর্মচারী সবার পা ধরে কান্নাকাটি করা। আদু ভাই ব্যর্থ হলেও আমরা আশা করি ব্যর্থ হবো না।
আদু ভাইয়ের প্রমোশন না পাওয়ার যদিও একটা কারণ ছিল। কিন্তু আমাদের প্রমোশন না পাওয়ার কোন কারণ নেই। প্রমোশন জিনিসটাকে যথাসময়ের পূর্বে এগিয়ে আনাটা আদু ভাই পছন্দ করতেন না। তবে আমাদের প্রমোশনটা আমাদের পছন্দ অপছন্দের ওপর নির্ভর করে না। আদু ভাইয়ের প্রমোশনের জন্য তার সহপাঠী, অনুজ, অগ্রজ, শিক্ষক সবাই আন্তরিক থাকলেও প্রমোশনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির প্রয়োজন ছিল সেটি হচ্ছে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর। আর এখানেই ছিল আদু ভাই’র সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। যেমন, ফারসি পরীক্ষার খাতায় একটিও ফারসি হরফ লিখেন নাই তিনি। ‘তার বদলে ঠাস-বুনানো বাংলা হরফে’ তিনি লিখেছেন ‘এই বঙ্গদেশে ফারসি ভাষা আমদানির অনাবশ্যকতা ও ছেলেদের উহা শিখবার চেষ্টার মূর্খতা সম্বন্ধে যুক্তিপূর্ণ একটি ‘থিসিস’। আবার অংকের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, প্রশ্নকর্তা ভাল-ভাল অংকের প্রশ্ন ফেলে কতকগুলো বাজে ও অনাবশ্যক প্রশ্ন করেছেন। সেজন্য এবং প্রশ্নকর্তার ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আদু ভাই নিজেই কতিপয় উৎকৃষ্ট প্রশ্ন লিখে তার বিশুদ্ধ উত্তর দিচ্ছেন। শেষে অবশ্য এটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, তার উৎকৃষ্ট প্রশ্নের বিশুদ্ধ উত্তর হিসেবে তিনি যে উত্তর করেছেন সেগুলোও সঠিক হয় নি। ভূগোলের খাতায় তিনি লিখেছেন, পৃথিবী গোলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে- এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, কোন রাজা কোন সম্রাটের পুত্র এসব কথার কোনো প্রমাণ নেই। ইংরেজির খাতায় তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের ছবি পাশাপাশি আঁকবার চেষ্টা করেছেন- অবশ্য কে যে সিরাজ কে যে ক্লাইভ, নিচে লেখা না থাকলে তা বুঝার সাধ্য ছিল না।
আদু ভাইয়ের সাথে বোধ করি এই একটি জায়গাতেই আমাদের তফাৎ রয়েছে। কারণ আমরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করে বিসিএস পরীক্ষার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কয়েকটি ধাপে কৃতকার্য হয়ে তবেই বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে যোগদান করেছি। আবার চাকরিতে যোগদান করে বিভাগীয় পরীক্ষা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে পদোন্নতি প্রাপ্তির সকল যোগ্যতা অর্জন করে পদোন্নতি নামক সোনার হরিণ লাভের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছি। পরীক্ষার খাতায় আদু ভাইয়ের মতো উল্টো প্রশ্নকর্তার ভুল ধরলে নিশ্চয়ই আমরা এসব পরীক্ষায় কৃতকার্য হতাম না।
অন্য সবার মতো আদু ভাই’র মনেও এক সময় পদোন্নতির প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে পাশ করা সম্ভব নয় বিধায় তিনি তার পদোন্নতির তদবিরের জন্য লেখককে দূত হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। লেখক যদিও আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষে তিনি নিজেই পদোন্নতির তদবিরের জন্য প্রধান শিক্ষকের নিকট গমনের ইচ্ছে পোষণ করেন। আমরাও আমাদের পদোন্নতির জন্য কখনো কখনো দূত নিয়োগ করি। বিভিন্ন টেবিলে ধরনা দেই। যদিও সময় মতো সফলতার হার খুবই কম। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে পদোন্নতি বিলম্ব করা এ ক্যাডারের নিয়মিত ঘটনা। বাস্তবতা বিবেচনায় পদোন্নতির এ হেন অবস্থায় আমাদের পরিবারের প্রধান কর্তাগণও অনেক সময় অসহায় ও নিরুপায়।
আদু ভাই মুখ ফুটে কখনো পদোন্নতি চান নি শিক্ষকদের নিকট। কারণ হিসেবে তিনি তার বক্তৃতায় বলেছিলেন তিনি নাকি তাদের আক্কেল পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষা শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এদের মধ্যে আক্কেল বলে কোন জিনিসই নেই। এরা নির্মম ও হৃদয়হীন। আক্ষেপ করে তিনি বলেছিলেন ‘যাঁদের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর হাজার হাজার ছেলের বাপ-মা ছেলেদের জীবনের ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন, তাঁদের আক্কেল কত কম। তাঁদের প্রাণের পরিসর কত অল্প!’
আদু ভাই তার প্রমোশন নিয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি যদি এতোই অযোগ্য হব তাহলে একজন শিক্ষকও কেন এই দীর্ঘ দিনে আমায় বললেন না : ‘আদু মিঞা, তোমার প্রমোশনের কোনো চান্স নেই, তোমার মাইনেটা আমরা নেব না।’ তার মতো আমাদেরও সরকার ও কর্তা ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বলতে হবে, আমরা যদি এতোই অযোগ্য হই তাহলে তারা কেন বলছেন না- ‘মিয়ারা তোমাদের প্রমোশনের কোন সুযোগ নেই, থাকলে থাকো না থাকলে না থাকো।’ তাহলে আমাদের প্রতীক্ষার প্রহরও গুণতে হতো না। পদোন্নতি নামক কোন জিনিস নিয়ে আর কানাঘুষাও করা লাগতো না।
যে বার আদু ভাই’র প্রমোশনের প্রতি প্রচণ্ড আবেগ তৈরি হয় সেবার তার এই বিপুল আগ্রহের পশ্চাতে ছিল তার বড় ছেলের ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পাওয়া। সেও একই স্কুলে পড়তো। আদু ভাই সতর্কতা অবলম্বন করে লজ্জার ভয় থেকে উদ্ধার প্রাপ্তির আশায় আগেই ছেলেকে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। নইলে ছেলে আর তিনি একই স্কুলের একই ক্লাসের ছাত্র হয়ে যেতেন। এতে লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে যেতো আরও। আমাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়া শেষ করে একই কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পূর্বেই আমাদের উচিৎ ঐ কলেজ থেকে বদলি হয়ে অন্য কলেজে গমন করা। এতে করে আমাদের মান কিছুটা হলেও আদু ভাই’র মতো অক্ষুন্ন থাকবে। কিন্তু বদলিও যে ছেলের হাতের মোয়া না এটি তো আমরা সবাই জানি।
সব তদবির আর সকল প্রচেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর আদু ভাই তার প্রমোশনের জন্য জান-প্রাণ দিয়ে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন, অসুস্থ অবস্থায় পালকিতে চড়ে স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তার এই আত্মনিয়োগ দেখে পাড়াসুদ্ধ লোক হেডমাস্টারকে অনুরোধ করেছিলেন তাকে প্রমোশন দিতে এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষ অবধি তিনি প্রমোশন পেলেও প্রমোশন উৎসব তিনি করে যেতে পারেন নি। যারা প্রমোশন উৎসবে দাওয়াত পেয়েছিলেন সবাই আদু ভাইয়ের জানাযা পড়ে অশ্রু ভেজা নয়নে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। আদু ভাই’র শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার কবরের টেবলেটে লেখা ছিল- Here sleeps Adu Mia who was promoted
from Class VII to Class VIII.
সকল চেষ্টা তদবিরের পর হেড মাস্টারের মতো উপরওয়ালাদের দয়ায় যদি কখনো প্রমোশন হয় আর প্রমোশন উৎসবের আগেই যদি আমরা আদু ভাইয়ের মতো কবর দেশের বাসিন্দা হই তাহলে শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের কবরের টেবলেটেও লেখা উচিৎ- Here sleeps Shepon Mia who was promoted from lecturer to assistant professor. তাহলে এটিই হবে আমাদের পরম আরাধ্য বিষয়, আমাদের শিক্ষা ক্যাডারের পরম স্বার্থকতা।
লেখক – শিপন আলম, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ, টাঙ্গাইল, (৩৪তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত)।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়