“নারী জাগরণের অগ্রদুত রোকেয়া” লেখক – নমিতা দাস
- Update Time : ০৯:২৭:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২২
- / ২০১ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
নারী জাগরণের অগ্রদুত, সমাজ সংস্কারক, নারী শিক্ষার অগ্রপথিক , ভারত বর্ষের প্রথম নারী বাদী যে উপাধিতে তাকে ভ’ষিত করা হোক তা হবে আংশিক বা খন্ডিত পরিচয়। তাকে দেখতে হবে সমগ্রতায়। নারী আন্দোলনের সামগ্রিক তার পরিপেক্ষিতে রোকেয়াকে বিশ্লেষন করলে, তিনি আজকের নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কতটা প্রসঙ্গিক তা অনুমান করা যায়। রোকেয়ার কর্মধারা ও লেখনী বিশ্লেষন করলে দেখাযায়, সমাজ কর্তৃক নারীর যে প্রথাগত ও গতানুগতিক ভ’মিকা তাকে চালনা করছেন। নারীর মানুষ হয়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় সকল অধিকার নারী যেন অর্জন করতে পারে তা ছিল রোকেয়ার কর্মের লক্ষ। গৃহস্থলি কাজ ছাড়া বাইরে জীবনে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানুষ হিসাবে নারীর যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা ও নিজস্ব সচেতনতায় নিয়ে আসাছিল তার জীবনের লক্ষ।
তাই রোকেয়া বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বানীর মাধ্যমে আপনারে দ্বীপ করে জ্বালো, আপনার যাত্রা পথে আপনাকে দিতে হবে আলো সমগ্র নারী জাতির জন্য । সেই সাথে তিনি নারী জাতিকে বলেছেন জাগ জাগ জাগ গোভগিনী। প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নয় জানি, সমাজ মহা গোলযোগ বাঁধাইবে কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতে হইবে। মানুষ হিসাবে নারীর অধিকার পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তা বোঝাতে গিয়ে রোকেয়া বলেছেন। পুরুষের স্বার্থ ও আমাদের স্বার্থ ভিন্ননহে। আমরাঅকর্মণ্য পুতুলজীবনবহনকরিবারজন্য সৃষ্টিহইনাই। রোকেয়া বলেছেন আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি, একটা পরিবারের পুত্র ও কন্যার যে প্রকার সমকক্ষতা থাকা উচিত, আমরা তাহাই চাই। যেহেতু পুরুষ সমাজের পুত্র. আমরা সমাজের কন্যা। তিনি আরো বলেছেন আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের অর্ধেক নহি , তাহা হইলে এই রূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইতো- পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস। পুত্রের জন্য যতখানি দুধ আমদানী হয়, কন্যার জন্য তাহার অর্ধেক, সেরূপ তো নিয়ম নাই। তবে কেন সম্পতির উত্তরাধিকারে নারী পুরুষের অর্ধেক পাইবে? নারী পুরুষের মধ্যে এই বৈষম্যের প্রশ্ন তুলেছেন রোকেয়া নারীর নিজস্ব ভ’মিকার কথাও বলেছেন, পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা অথবা দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক এবং আমরা যে গোলাম জাতি নাই, এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। নারী পুরুষের স্বার্থ সম্পূরক। কারণ পুরুষের উন্নতিও নির্ভরশীল নারীর উন্নতির উপর। জেন্ডার সমতার সার বক্তব্য হচ্ছে এ ধারনা।
নারী কেবলমাত্র অর্থনৈতিককারণেপুরুষের কর্তৃত্ব মেনে নেয়না, এর পেছনেরয়েছেসমাজের তৈরী দীর্ঘদিনের সামাজিক সাংস্কৃতিক মুল্য বোধ, যা প্রতিষ্ঠা করেছে সমাজের ক্ষমতার কাঠামো। যাকে বলা হয় পিতৃ তান্ত্রিক মুল্য বোধ। এই প্রসঙ্গে আজ থেকে শত বছর পূর্বে রোকেয়া বলেছেন, আমাদের স্বাধীনতা ও অধিনতা জ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ টুকু থাকিল না। তখন কাজেই তাঁহারা ভুস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্রমে আমাদের স্বামি হইয়া উঠিলেন। আর আমরা ক্রমশ তাঁহাদের গৃহপালিত পশু পক্ষির অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পতির বিশেষ হইয়া পরিয়াছি। আমাদিগকে তাঁহারা হৃদয় পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া জ্ঞান সূর্যালোক ও বিশুদ্ধ বায়ু হইতে বঞ্চিত রাখিয়াছেন। তাহাতেই আমরা ক্রমশ মরিতেছি।
নারীর ক্ষমতায়ন অর্থাৎ সমাজে রাষ্ট্রে পরিবারে নারীর প্রতি সকল ধরণের বৈষম্য দূরীকরন আজকের নারী আন্দোলনের এজেন্ডা। মানুষ হিসাবে নারীর ব্যাক্তি অধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতা অর্জন হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আজকের নারীরা অগ্রসর হচ্ছেন। অগ্রসরমান নারীদের দুধরনের কর্মচক্রে আবদ্ধ হতে হচ্ছে- বাইরে উৎপাদন মুখী কর্ম ও গতানুগতিক ভাবে সমাজে কতৃক নির্ধারিত গৃহের কর্ম। নারীর এই দ্বৈত দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে নারীকে পেশাজীবি হিসাবে দক্ষতার সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করেছে। নারী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে সমাজ রাষ্ট্র পরিবার নারীর পাশে সেভাবে সহায়ক শক্তি হিসাবে দাঁড়াচ্ছে না। এ বিষয়টি নিয়ে আজকের নারী আন্দোলনকে ভাবতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নারী ও পুরুষের উভয়েরই মানসিক তার পরিবর্তন।
রোকেয়া নারীর প্রথাগত ভ’মিকা চ্যালেঞ্জ করে মেয়েদের কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন । কন্যা গুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও তারা নিজের অন্ন – বস্ত্র করিবে।
রোকেয়া বলেছেন আমরা নারীরা সমাজের অর্ধঅঙ্গ। আমরা পরিয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরুপে?
কোন ব্যাক্তি এক পা বাধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কত দূর চলিবে। পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ননহে একই। তাহাদের জীবনের লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। নারি পুরুষের এই অভিন্ন অধিকার ধারনা হচ্ছে জেন্ডার সমতা। যা নারীপুরুষকে ‘মানব’ হিসাবে দেখার লেন্স/ নারী-পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, তার কারণ চিহ্নিত করাএবং সে ক্ষেত্রে করনীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট স্বচ্ছ ও বলিষ্ঠ দৃষ্টি ভঙ্গির অধিকার ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া জন্ম গ্রহন করেছিলেন রংপুর জেলার পায়রাবন্দ্ব গ্রামে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বব। তারা দুই ভাই ও তিন বোন। বড় বোন করিমুনন্নেসার কাছে তিনি বাংলা শিখতেন। এবং বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের কাছে রাতের আলোয় ইংরেজী শিখতেন। সেই সময় মুসলিম পরিবারে আরবি ও উর্দু ভাষা ছাড়া বাংলা ইংরেজী চালু ছিলনা মেয়েদের জন্য। কোরানশরিফ শিখার জন্য আরবি জানতে হত। রোকেয়ার ১৬ বৎসর বয়সে বিয়ে হয়। তার স্বামীর নাম অনুসারে তার নাম হয় রোকেয়া সাখাওয়াত। তার ডাক নাম ছিল রুকু। ভাগলপুরে ছিল স্বামীর বাড়ী। স্বামী সরকারী চাকরী করতেন স্বামীর পরিবারে প্রায় সকলেই উর্দুতে কথা বলতেন। রোকেয়া পড়াশুনা চলার পথে সাহায্য করেছিলেন প্রথমে তার বোন করিমুন্নেসা ভ্রাতা ইব্রাহিম সাবের ও বিবাহের পরে তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন। এই পড়াশুনা স্কুল কলেজে হয় নাই এটা হয়েছে বাড়ীতে গভীর রাতে মোমবাতির আলোতে। কারণ মেয়েদের পড়াশুনা করতে নাই তখনকার সমাজে। তার স্বামীর সঙ্গে মাত্র ১০ বৎসর সংসার করেছেন।
তার উপন্যাস পদ্ম রাগ, অবরোধ বাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন ইত্যাদি।
প্রথমে তিনি ৭ টি মেয়ে নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ভাগলপুর গ্রামে। কিন্তু পারিবারিক কারণে সেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পরে কলকাতায় নতুন করে আবার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আস্তে আস্তে অনেক মেয়েরা পড়–াশুনা করার সুযোগ পায়। সমাজমান সে প্রতিষ্ঠিত করা ও নারীর নিজস্ব সচেতনতায় নিয়ে আসাছিল রোকেয়ার জীবনের লক্ষ্য। এই মহিয়সি নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।
লেখক – নমিতা দাস, প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, রাজবাড়ী জেলা শাখা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়