স্মরণ : এক আপাদমস্তক শিল্পী ছিলেন রাজবাড়ীর কৃতি সন্তান ‘মনসুর উল করিম’
- Update Time : ০৭:০৯:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ অক্টোবর ২০২২
- / ৪১ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের সমকালীন প্রেক্ষাপটে শিল্পী মনসুর উল করিম নিজস্বতা অর্জন করেছেন আশির দশকের শুরু থেকে। এ দেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে তাঁর চিত্রভাষা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। মনসুর তাঁর নিজস্ব শিল্পবৃত্ত নির্মাণের পাশাপাশি প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের। সেই প্রেরণা তাঁর বিদায়ের পরও বহমান। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর মনসুর উল করিমের মৃত্যুদিবস।
যড়মনসুর উল করিম স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসের সময়ের বিচারে এখনো নবীন। জয়নুল-কামরুল-সুলতান-সফিউদ্দিন-কিবরিয়া প্রজন্ম যে ধারা দেখিয়ে গেছেন, তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে মুর্তজা বশীর-আমিনুল ইসলাম-কাইয়ুম চৌধুরী-রশীদ চৌধুরীদের শিল্প রসদ।
এই শিল্পপরম্পরায় মনসুর নিজেকে গড়ে তুলেছেন অগ্রজদের কাজের অনুপ্রেরণায়। একই সঙ্গে নিজস্বতায় দিক বদল করতে চেয়েছেন ভিন্ন ভাষায় নতুন এক শিল্প ঘরানা গড়ে।
মনসুরের ক্যানভাসে মূর্ত হয়েছে ভারতীয় চিত্রকলার লোকজ কোলাজ, পারস্য ও ইউরোপীয় ঘরানার মিশেলে নতুন ভাষা ও ভাব। তাই মূর্ত ও বিমূর্ততার মিশেলে মনসুরের রঙের জগৎ আপাত দুর্বোধ্যতার আড়ালে সবার চেয়ে আলাদা।
এই পথ পাড়ি দিতে মনসুরকে চলতে হয়েছে অনেক দূর। ছোট্ট নদী চন্দনা আর প্রমত্তা পদ্মা ছিল তাঁর আঁতুড়ঘর।
১৯৫০ সালে শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে। তবে বসবাস তাদের রাজবাড়ী জেলা শহরের সরকারী আদর্শ মহিলা কলেজের সামনের বাড়ীতে। যদিও তিনি জেলা শহরের কাজী বাঁদা গ্রামের একটি আর্ট গ্যালারী স্থাপন করেছেন।
মনসুর ছিলেন কালিকাপুর গ্রামের শেখ আব্দুল জলিল মিয়া ও ফাতেমা খাতুনের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রসন্তান। সংসারে অভাব না থাকলেও দারিদ্র্য দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাই শিখে নিয়েছিলেন জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার মন্ত্র। এর মধ্যেও ছেলেবেলা থেকে রংতুলির আকর্ষণ ছাড়তে পারেননি।
শৈশবের কোনো এক বিকেলে ঘাসের ওপর শুয়ে উদার আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে প্রথম মনের ভেতর দানা বাঁধে ছবি আঁকার স্বপ্ন। স্লেট আর ড্রয়িং খাতায় প্রকৃতির ছবি আঁকতে আঁকতে মনসুর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এলেন রাজবাড়ী মহকুমা শহরে। ভর্তি হলেন তদানীন্তন শতবর্ষী গোয়ালন্দ হাই স্কুলে।
মফস্বল শহর রাজবাড়ীতে ছাত্রাবস্থায়ই মনসুর উল করিম একজন দক্ষ শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। পরিচিত মহলে সবাই ডাকত তাঁকে ‘আর্টিস্টম্যান’ হিসেবে।
নাটক-সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ফটো দেখে ছবি আঁকা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চের পেছনের পর্দায় নদীর দৃশ্য, নৌকা, তালগাছ, ঘাসফুল এঁকে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তখন চোখে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন আরো গভীর। অবশেষে হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মনসুর ভর্তি হলেন ঢাকা আর্ট কলেজে, ১৯৬৭ সালে।
ছাত্রাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে মনসুরকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ, শিল্পী আবুল বাসেত, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, শিল্পী মুর্তজা বশীর প্রমুখ। কখনো এঁদের ছাপিয়ে তাঁর ওপর ভর করেছিল পাশ্চাত্যের পিকাসো, সেজান, দালিদের ছায়া।
ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন শেষে ১৯৭৩ সালে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ের চারুকলা বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে। চট্টগ্রামে বিয়ে করে সংসার শুরু করলেন শামীম আকতারের সঙ্গে। শিল্পীর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো নগরীর নালাপাড়া এলাকায়।
নিজের কাজে মনসুরের কখনো তৃপ্তি আসেনি। পুনরাবৃত্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি বারবার ফ্রেম বদল করেছেন। এই শিল্পিত পরিক্রমায় আমরা দেখেছি ১৯৭৪ সালের স্পষ্ট ফিগারেটিভ কাজ, যা ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু। ক্রমে ১৯৭৭ সালের ক্যানভাসে অস্পষ্টতার আধিক্য চোখে পড়ে, যা ১৯৮৪ সাল নাগাদ বিমূর্ততায় রূপ নেয়।
এরপর দেখি ১৯৮৭-এর প্রকাশবাদ বা এক্সপ্রেশনিজম, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত মূর্ত-বিমূর্তের সংশ্লেষণ, ১৯৯৬-এর প্রক্ষেপণ, ২০০০ পরবর্তী সময়ে প্রকাশবাদ ও মিস্টিক ফর্মের মিলন।
মনসুর তাঁর কাজে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন মূলত প্রকৃতি থেকে শিল্পরস ক্যানভাসে আত্মস্থ করার মাধ্যমে। এই শিল্পভাষা তাঁর একান্ত।
দীর্ঘ পাঁচ দশকের বিরামহীন যাত্রায় মনসুরের ক্যানভাস ব্যস্ত ছিল বাস্তববাদ, পরাবাস্তববাদ, প্রকাশবাদ, অভিব্যক্তিবাদ ও গঠনবাদের চর্চায়। তাঁর রংতুলিতে মাটির গন্ধের আমেজ ঝাঁঝালো। দৃষ্টির নীরক্ত ভঙ্গি নিরাসক্ত। মানুষের অবয়বগুলো আরো অবয়বহীন। প্রাণবন্ত রঙের নাচন যেন আরো রঙিন।
অ্যাক্রিলিক ও তেল রঙে মৌলিক ধাঁচে নিরীক্ষাধর্মী কম্পোজিশন ও স্পেস ব্যবহারের মুনশিয়ানা মনসুরের কাজকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। তাঁর অন্তর্মুখী সমাজ ভাবনার বিপ্রতীপ রূপ আমরা দেখতে পাই। ক্যানভাসে বারবার দেখা যায় লোকজ মোটিফের সরব উপস্থিতি।
আপাদমস্তক একজন জাতশিল্পী হিসেবে মনসুর কখনো তাঁর কাজের ধারার সঙ্গে আপস করেননি। কমার্শিয়াল ঘরানার গড্ডলিকায় নিজেকে ভাসিয়ে দেননি।
তাঁর কিছু কাজে পূর্বসূরিদের অনুপ্রেরণা প্রবল হলেও অঙ্কনশৈলী ও রঙের অনুবাদে তাঁর স্বকীয়তা স্পষ্ট।
১৯৭২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মনসুর ১৭টি একক প্রদর্শনী করেছেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। দেশে-বিদেশে ৭০টিরও বেশি প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।
একজন সমাজসচেতন শিল্পী হিসেবে দেশ-জাতির প্রতি কর্তব্যের দায় মনসুর এড়াতে পারেননি। অংশ নিয়েছিলেন উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে। শহীদ মিনারে প্রথম ‘অ’ অক্ষরের পুষ্পস্তবক অর্পণের সূচনা করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শিল্পীকে বারবার তাড়িত করেছে। মৃত্যুর দুই বছর আগে ‘বুনন আর্ট স্পেস’ চত্বরে নির্মাণ করেছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘এই মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান’। এটি নিঃসন্দেহে ভাস্কর হিসেবে মনসুরের অন্যতম সেরা কাজ।
মনসুর উল করিম তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সম্মানসূচক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননার মধ্যে অর্জন করেছেন ১৯৯৪ সালে ভারতে অষ্টম ইন্টারন্যাশনাল ট্রিয়েনালের গ্র্যান্ড পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ষষ্ঠ এশিয়ান বিয়েনালে গ্র্যান্ড পুরস্কার। এ ছাড়া একাধিকবার অর্জন করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেরা শিল্পীর পুরস্কার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৫ সালের ১৫ জুন অবসর নিয়ে মনসুর ফিরে গিয়েছিলেন প্রিয় রাজবাড়ীতে। নিজ সঞ্চিত অর্থে নির্মাণ করেন প্রায় এক বিঘা জায়গার ওপর বুনন আর্ট স্পেস।
মনসুর উল করিম ভালোবাসতেন গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ, পৌষের সোনাঝরা রোদ, নবান্নের ফসল, সজল বর্ষা। ভালোবাসতেন উদোম গায়ে অঝোর বৃষ্টিতে মাছ ধরতে। কখনো ভোলেননি গভীর রাতে শান্ত পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার স্মৃতি। আলাপচারিতায় কথাগুলো বহুবার উল্লেখ করেছেন। মনসুরের ক্যানভাসে এ কারণেই প্রকৃতি ও মানুষ জড়াজড়ি করে মিশে ছিল। তাঁর রং ও রেখার প্রতিটি সিরিজে মূর্ত হয়ে উঠেছে আবহমান গ্রাম-বাংলার ছবি। সৌজন্যে- দৈনিক কালের কণ্ঠ।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়