“ইতিহাস ঐতিহ্যের নববর্ষ” : লেখক- মুহাম্মদ রাজ্জাকুল আলম

- Update Time : ০৯:৪৩:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল ২০২৪
- / ১৩৪ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
“প্রভাত সূর্য এসেছে রুদ্রসাজে,
দুঃখের পথে তোমার তুর্য বাজে।”
তুর্য বাজিয়ে প্রকৃতিকে রাঙিয়ে ঝড়ের বেগে আসে বৈশাখ। পুরাতন বছরের হিসাব চুকিয়ে প্রতিবছর ফিরে আসে পহেলা বৈশাখ। আগমন ঘটে নতুন বছরের। নববর্ষে দেশের সর্বত্রই বয়ে যায় উৎসবমুখর পরিবেশ। বাংলা নববর্ষের উৎসব শুরু হয় বৈশাখ মাসের ১ তারিখ এবং ইংরেজি মাসের ১৪ এপ্রিল।
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি নববর্ষ হিসেবে পালিত হয় যা বাঙালি জাতির সর্বজনীন লোক উৎসব হিসেবে পরিচিত। এ দিনে নতুন বছরকে আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয়। অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।
বাঙালি জাতির জীবনে পহেলা বৈশাখ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। সংস্কৃতির শেকড় জনমানুষের অন্তরে প্রোথিত। কালচার অর্থ কর্ষণ বা চালনা করা বা সংস্কার করা। আমরা কাল বিচ্ছিন্ন কোন জাতি নই বা প্রবাহ বিচ্ছিন্ন নই। আবহমানকাল ধরে যে সংস্কৃতি প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও দেশের মাটির আপন পরিবেশে লালিত ও পরিপূর্ণ তাই হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। যা নববর্ষ নামে পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই দিনটির উপর ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালীর রয়েছে অখণ্ড উত্তরাধিকার।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতু ধর্মী উৎসব হিসেবে। কৃষিকাজের সুবিধার্থে মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। প্রথমে যা ফসলীসন এবং পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। হিজরী চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ভিন্ন ভিন্ন তারকারাজির নাম অনুসারে বাংলা ১২ মাসের নামকরণ করা হয়। মূলতঃ বিশাখা থেকে বৈশাখ মাসের নামকরণ এরপর পর্যায়ক্রমে জেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপা থেকে ভাদ্র, কার্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রহইনি থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
আগের দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। অগ্র অর্থ প্রথম এবং আয়ন অর্থ বৎসর বা ধান। পরবর্তীকালে বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা শুরু হয়। সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করতে অসামান্য, অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আকবর এলাহী সন নামে প্রথমে বর্ষপঞ্জি শুরু করলেও তা টিকতে পারেনি। প্রায় একই সময় প্রবর্তিত বাংলা সন কেবল টিকেই থাকেনি বিচ্ছিন্ন বাঙ্গালীদের জাতীয় চেতনায় উদ্ধৃত করেছে।
বাংলা সন চালু হবার পর জমিদার ও নবাবরা নববর্ষে পূর্ণ্যাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সেই সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূ-স্বামিরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। গ্রামগঞ্জে ব্যবসায়ীরা নববর্ষে তাদের দোকানের পুরাতন হিসাব সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। যা হালখাতা নামে পরিচিত। সেদিন সকল খরিদ্দারকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। খরিদ্দারেরা এদিন পুরাতন হিসেব পরিশোধ করার চেষ্টা করে থাকে।
নববর্ষকে উৎসব মুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা যা সার্বজনীন লোকজ মেলা। যে মেলা সাধারণত একদিন থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ মেলা হাটবাজারে, নদীর তীরে, মন্দির প্রাঙ্গণে, শহরের রাস্তার ধারে মূলত বসে। মেলায় স্থায়ী কৃষিজাত পণ্য লাঙ্গল-জোয়াল মইসহ লোকশিল্প পণ্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, হস্তশিল্পজাত পণ্য, মৃৎ শিল্পজাত পণ্য পাওয়া যায়। শিশুদের জন্য মাটির পুতুল, রান্নার সামগ্রী, প্লাস্টিকের সামগ্রী, কাঠের খেলনা, মহিলাদের সাজ সজ্জ্বার সামগ্রীর পাশাপাশি চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, সন্দেশ, কদমা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির সমারোহ থাকে মেলায়। বাঁশি কাশি ও বেলুনের সাজসজ্জাও চোখে পড়ার মতো বিষয়। বিনোদনের জন্য থাকে পালাগান, যাত্রাগান, নাটক, গাজীর গান,কবি গান, পুঁথিপাঠ, বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালি গান। লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যান উপস্থাপিত হয় মেলায়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস, মেলার বিশেষ আকর্ষণ। তাছাড়া বায়োস্কোপের আয়োজন থাকে মেলায়। কোন কোন জায়গায় লাঠি খেলা, কুস্তি খেলা, সাপ খেলা এবং বলি খেলার আয়োজন করা হয়।
বিবর্তিত সমাজের বিবর্তনের ধারায় নববর্ষের রূপের পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে কিছু উৎসব বিলুপ্তি হয়েছে আবার কিছু উৎসব সংযোজিত হয়েছে। একসময় ঘুড়ি উড়ানো ও মুন্সীগঞ্জে গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল। এছাড়া ষাড়ের লড়াই, নৌকা বাইচ, বহুরূপীর সাজ বর্তমানে আর নেই। তবে এখনও চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে জব্বারের বলি খেলা এবং রাজশাহীর গম্ভীরা প্রচলিত রয়েছে।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। শোভাযাত্রায় পশু, পাখির মুখ আকৃতির ছবিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয় রঙ-বেরঙের মুখোশ ও আল্পনার মাধ্যমে। উল্লেখ্য ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অধরা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
বর্তমানে নগর জীবনে অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের মাধ্যমে নববর্ষকে বরণ করবার প্রস্তুতি শুরু হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। এদিন সকলে ঐতিহ্যবাহী বাঙালিয়ানা পোশাক পরিধান করার চেষ্টা করে থাকে। তরুণীরা লাল পেড়ে শাড়ি, হাতে চুড়ি মালা, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা, কপালে টিপ আর ছেলেরা পায়জামা, পাঞ্জাবি ও মাথায় গামছা ব্যবহার করে। এছাড়া অনেকেই দিনটিতে হাতে, মুখে ফুলকি আঁকে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিধান করে থাকে অনেকে। পহেলা বৈশাখে সকালে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ, কাঁচা মরিচ খাবার মাধ্যমে গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়। বর্তমানে নববর্ষে তরুণ-তরুণীরা ঘোড়ার গাড়ি, টমটম গাড়ি, নৌকায় এবং বিভিন্ন যানবাহনে ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
নববর্ষ উপলক্ষে শুভ কামনা করে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো আধুনিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। এ উপলক্ষে বহু দোকানে শুভেচ্ছা কার্ড বিক্রি করা হয়। অনেকে নিজের তৈরি শুভেচ্ছা কার্ড প্রিয়জনকে উপহার হিসেবে দিয়ে থাকে। সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শুভেচ্ছা কার্ড প্রদান করা হয়।
বাংলার নববর্ষ পালন উপলক্ষে ঢাকার রমনা বটমূল, চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলা, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টিএসসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে দিবসটি পালিত হয়।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, ছায়ানট, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আলোচনা সভা, বর্ণাঢ্য মিছিল, বৈশাখী মেলার আয়োজন করে থাকে। মেলা উপলক্ষ্যে গণমাধ্যম বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে থাকে। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ জাতীয় উৎসব এ পরিণত হয়েছে।
বাংলা নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলা বৈশাখী উৎসব পালন করে থাকে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তিন দিনব্যাপী এই উৎসব পালন করে। এই উৎসবকে চাকমা বিজু, মারমা সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরা বৈসুক উৎসব পালন করলেও তিন অদ্যক্ষরের সমন্বয়ে বৈসাবী নামে পরিচিত। মারমারা এই দিনে ঐতিহ্যবাহী পানি খেলার আয়োজন করে থাকে। পুরাতন বছরের শেষ দু’দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এই তিন দিন এই উৎসব পালিত হয়।
বাংলাদেশের যেসব স্থানে বৈশাখী মেলা পালনের ঐতিহ্য রয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছরিঘাট মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মনিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি- বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, টুংগীপাড়া, মাদারীপুর, মেহেরপুরের মুজিবনগর এলাকা। ঢাকার নিকটবর্তী সুভাত্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর স্নানঘাটা মেলা, শ্যাম সিদ্ধি মেলা, মিরপুর দীগাও মেলা, কুকুটিয়া মেলা এবং রাজনগর মেলা উল্লেখযোগ্য।
দিনাজপুরের ফুলতলা রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলার বৈশাখী মেলাও বর্তমানে বিরাট উৎসবের রূপ নিয়েছে।
নববর্ষকে কেন্দ্র করে বহু বিচিত্র মানুষের সমাগম হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের হিংসা-বিদ্বেষ-দ্বিধা দূর হয়ে যায়। গ্রামের এই ধরণের মেলা মানুষের জীবনে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ। পহেলা বৈশাখ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় তবুও প্রত্যেক বাঙালি এই দিনটি আড়ম্বরে পালন করে।
১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বৈশাখী আয়োজন নির্মূল করার চেষ্টা করে কিন্তু বাঙালির মেধা মনন, চিন্তাশক্তি সর্বোপরি মনোবলের কাছে হেরে যায় বিধ্বংসী চক্রান্ত। এ জাতীর কঠোর স্বকীয়তাবোধের চেতনায় নববর্ষ পালন দমাতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৬৭ সাল থেকে ঢাকার রমণায় বর্ষবরণ উৎসবের শুরু হয়। সম্মিলিত আন্দোলনের ফসল পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটির উপরও আঘাত আসে এক সময়। কিন্তু বর্ষবরণ উৎসব প্রতিবাদী আন্দোলনের রূপ লাভ করে। সমগ্র বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করে সেই সাথে পহেলা বৈশাখ উদযাপন কন্টকমুক্ত হয় এবং পাকাপোক্ত হয়। আসুন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হই এটাই হোক নববর্ষের কাঙ্খিত প্রত্যাশা। তথ্যসূত্র: গুগল।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, মীর মশাররফ হোসেন কলেজ, সোনাপুর, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়