“হেনা দাস একজন বিপ্লবী নারী”- লেখক : শারমিন রেজা লোটাস

- Update Time : ১১:০১:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / ৪৩ Time View

রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
বাংলার নারী জাগরণে যে ক’জন নারী তাঁদের সময় পেরিয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হেনা দাস। তিনি ছিলেন শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য নেত্রী। বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। শুধু হেনা দাস বললে নামটি অপূর্ণ থেকে যায়। এই নামটির পূর্বে বিপ্লবী শব্দটি একান্ত ভাবে অপরিহার্য।
১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী হেনা দাস সিলেটে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সতীশ চন্দ্র দত্ত ছিলেন একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। হেনা দাসের মা মনোরমা দত্ত ছিলেন চুনারু ঘাট থানার নরপতি গ্রামের জমিদার জগত্চন্দ ্রবিশ্বাসের বড়ো মেয়ে। পাঁচভাই ও দুই বোনের মধ্যে হেনা দাস সর্বকনিষ্ঠ। সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে হেনা দাস এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্কে অংশ গ্রহণ করেন। মাঝে মাঝে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাসও করেন। হাইস্কুল পার হবার আগেই হেনা দাস স্থানীয় বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক কর্মকান্ডে জড়িত হন। স্থানীয় অনেক রাজনীতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে হেনা দাস সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে ধারণা পান। বুঝতে পারেন দেশের জন্য কিছু করতে হবে। বিশেষ করে নারী সমাজের জন্য তিনি সব সময়ই কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য ত্রিশ দশক ছিল বিক্ষোভ, আন্দোলন ও বিদ্রোহের সূচনা কাল। হেনা দাসের বাড়ি ছিল সিলেট শহরের কেন্দ্র স্থল পুরানলেন পাড়ায়। বাড়ির কাছে ঐতিহাসিক গোবিন্দ পার্ক ছিল মূলত সমাবেশের কেন্দ্র। ফলে তিনি কাছ থেকে শ্লোগান, মিছিল ও সভা-সমাবেশ দেখেছেন। দেখেছেন স্বদেশিদের ওপর বর্বর পুলিশি নির্যাতন। এসব তাঁর মনের গভীরে দাগ কেটেছিল। এভাবেই হেনা দাসের মনে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জন্ম নেয়। ফলে কৈশোর থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি গার্লস গাইডে যোগ দেন। সভা-মিছিল, গার্লস গাইডের নানা কর্মতৎপরতায় যোগ দিতে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারেন নি। তাই বলে থেমেও যান নি।
১৯৪০ সালে সরকারি অগ্রগামী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ভর্তি হন সিলেট মহিলা কলেজে। এ সময় তার রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। তখনদ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হেনা দাসকলেজেরসহপাঠীদের সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় জন রক্ষা কমিটি গঠনের কাজে অংশ নেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রচারের পাশাপাশি পাড়া কমিটির মাধ্যমে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষক ও স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী গঠনেও তিনি অংশ গ্রহণ করেন। এসব তৎপরতার মধ্যেই ১৯৪২ সালে তিনি সিলেট মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাশ করেন। এরপর কয়েক বছর রাজনীতির জন্য লেখা পড়া বন্ধ থাকে। নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতা কাটিয়ে দীর্ঘদিন পর তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং ১৯৫৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ প্রথম পর্ব এবং ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হেনা দাস শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। তখন শিক্ষক সমিতির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই সমিতির পক্ষ থেকে তিনি ভারতে গিয়ে দেশের পক্ষে কাজ করেন। বিদেশিদের আর্থিক সহায়তায় শিক্ষক সমিতি ৫০টি শরণার্থী শিবিরে শিশুদের জন্য বিদ্যালয় খুলে। হেনা দাস ওই বিদ্যালয় গুলোর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। আবার শুরু করেন শিক্ষকতা। ১৯৭৮ সালে হেনা দাস বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সব সময়ই তাকে পাওয়া গেছে সামনের সারিতে। ১৯৭৮ থেকে টানা ১৪ বছর তিনি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য। ১৯৮৬ সালে শিক্ষকদের চারটি দাবি আদায়ের জন্য আবার আন্দোলন শুরু করেন হেনা দাস। তত্কালীন স্বৈরচারী সরকার শিক্ষক ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করলে তিনি ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ১ মাস ৮ দিন তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি থাকেন। সব বাধা উপেক্ষা করে অব্যাহত ভাবে তিনি অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে গিয়েছেন। ১৯৭৯ সালেও শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাঁকে কারা বরণে যেতে হয়। এর আগেও ১৯৭৭ সালের ৫ মে ঢাকার বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অফিস থেকে ৫৪ জন শিক্ষকসহ গ্রেপ্তার হয়ে ছিলেন তিনি। তিন দিন কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টি করার জন্য তাকে বার বার যেতে হয়েছে আত্মগোপণে। আত্মগোপণ কালেও তিনি পার্টি গড়ে তোলার কাজ করেছেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে আমৃত্যু ভূমিকা রেখেছেন কমরেড হেনা দাস। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণ সম্মিলন- এমন অনেক সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন এই লড়াকু নেত্রী। প্রায় তিন যুগ শিক্ষকতার পর হেনা দাস ১৯৮৯ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। হেনা দাস ছিলেন মহিলা পরিষদের সভানেত্রী।
কবি সুফিয়া কামাল মারা যাওয়ার পর ২০০০ সালে তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নারী ও শিক্ষক আন্দোলনের তার ভূমিকা ছিল অনন্য। রাষ্ট্রীয় ভাবে তিনি ‘রোকেয়া পদকে’ সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়া সুনামগঞ্জ পৌর সভা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, আহমেদ শরীফ ট্রাস্টসহ তিনি বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। রাজশাহীর একটি প্রতিষ্ঠান হেনা দাসের ওপর একটি অডিও ভিজুয়াল ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে। নারী পক্ষ ও নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত দুটি বই-এ হেনা দাসের সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। হেনা দাস কেবল একজন সাহসী, সংগ্রামী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বই নন, তিনি একজন লেখিকাও বটে। ইতিমধ্যে হেনা দাসের অর্ধ ডজন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বই গুলো হলো- ‘উজ্জ্বল স্মৃতি’, ‘শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন’, ‘স্মৃতিময় দিন গুলো’, ‘নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা’, ‘স্মৃতিময়-’৭১’ এবং‘চার পুরুষের কাহিনী’। হেনা দাস তাঁর আত্ম জীবনী লিখেছেন ‘চার পুরুষের কাহিনী’ শিরোনামের বইটিতে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে হেনা দাসের লেখা বিভিন্ন কলাম ও প্রবন্ধ ছাপাহয়েছে। এসব লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবন্ধ সংকলন’ শিরোনামে আরেক টিবই। সাহিত্য প্রকাশ এর মফিদুল হক‘ মাতৃমুক্তি পথিকৃত’ নামে তাঁর জীবনের উপর একটি বইপ্রকাশ করেছেন। ২০০৯ সালের ২০ জুলাই হেনা দাস মারা যান, কিন্তু রেখে যান তাঁর বলিষ্ঠ সংগ্রামী জীবনের আদর্শ। নতুন প্রজন্ম তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক – শারমিন রেজা লোটাস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, রাজবাড়ী জেলা শাখা, রাজবাড়ী।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়