“২০ জুন কবি সুফিয়া কামাল- এর জন্মদিন” – লেখক : নমিতা দাস

- Update Time : ০৮:৩৮:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২
- / ৪২ Time View

রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
সাম্য
কবি সুফিয়া কামাল
সতেকের সাথে সতেকহও
মিলায়ে একত্রিত।
সব দেশে সব কালে কালে সবে
হয়েছে সমুন্নত।
বিপুলা পৃথিবী, প্রসারিত পথ,
যাত্রিরা সেই পথে,
চলে কর্মের আহ্বানে কোন
অনন্তকাল হতে
মানবজীবন শ্রেষ্ঠ,কঠোর
কর্মে সে মহীয়ান,
সংগ্রামে আর সাহসে প্রজ্ঞা
আলোকে দীপ্তিমান।
পায়ের তলার মাটিতে, আকাশে
সমুখে,সিন্ধ জলে
বিজয় কেতন উড়ায়ে মানুষ
চলিছে দলে দলে।
সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালে বরিশালে শায়েস্তাবাদের রাহাত মঞ্জিলে ২০ জুন জন্ম গ্রহণ করেন মামার বাড়ীতে। সেইসময় স্কুল কলেজে পড়ার কোন সুযোগ ছিলনা। পারিবারিক নানা উত্থান- পতনের মধ্যে স্ব-শিক্ষায় হয়েছেন কবি। ১৯১৮ সালে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সুফিয়া কামালের সভা জায়গা করে নেয় রোকেয়ার কথা ও কাজ। ১৯২৬ সালেসুফিয়াকামালেরপ্রথমকবিতা‘বাসন্তী” সে সময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে তার গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিতহয়্ ।১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’র মুখবন্ধ লেখেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেশ বিভাগের আগে কিছু কাল তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহঢাকায়চলেআসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠনক চিকাচাঁর মেলাপ্রতিষ্ঠাকরেন। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েরপ্রথম হোস্টোলকে রোকেয়া হল নাম করণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালেতিনিছায়ানটের প্রেসিডেন্টনির্বাচিত হন।১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রামে কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭০ সালেমহিলাপরিষদ গঠন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন।
সুফিয়া কামাল ৫০ টিরও বেশী পুরস্কার অর্জন করেন। এরমধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি হল পাকিস্থান সরকারের তমখা-ই-ইমতিয়াজ(১৯৬১) সেটি তিনি প্রত্যাখান করেন। ১৯৬৯ বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেলিন পদক পুরস্কার। একুশে পদক (১৯৭৬), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯৭)।
তিনি বলেছেন পৃথিবীর অনেক মহৎ কাজের পেছনেই ছিল মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, অসীম সাহস, সম্মিলিত সাধনা ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই মানুষ এই পৃথিবীতে তার বিজয় ঘোষনা করেছে। এই জন্য ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও শ্রেণী ভেদে সকল মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সোহাদ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
এই মহিয়সী নারী কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন।
তার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত কবিতা
ক) কবিতার নামপল্লী স্মৃতি ঃ
বহুদিন পরে মনে পরে আজি পল্লী মায়ের কোল
ঝাউ-শাখে সেথাবণলতা বাধিহরষে খেয়েছি দোল
ফুলের কাঁটার আঘাত সহিয়া কাঁচা পাকাকুল খেয়ে
অমৃতের স্বাদ লাভিয়াছি যেনগাঁয়ের দুলালী মেয়ে
চৈত্র নিশির চাঁদিমায় বসি শুনিয়াছি রুপকথা,
মনে বাজিয়াছে সুয়ো-দুয়োরাণীর দুঃখিনী মায়ের ব্যাথা,
তবু বলিয়াছি মান গলা ধরে, মাগো সেই‘কথা’বল
রাজার দুলালে পাষাণ করিতে, ডাইনী করেছিল ছল?
সাতশ সাপের পাহারা কাটায়ে পাতাল বাসিনী মেয়ে
রাজার ছেলেরে বাঁচায়েকি করে? পৌছিল দেশে যেয়ে।
খ) পুরনো স্মৃতি ঃ
আমি থাকি তামমাটি হয়ে লুটে দীঘি দরিয়ার কুলে
দেখিতেনা কেহ, চিনিতনা কেহ, মনে করিতনা ভুলে?
আজ বড় জ্বালা ! জানানোতো কোন, খরনিয়া
পরিণাম আর, আপন পরের নানান ভাবনা নিয়া।
তুমি বোন মোর ভাল বাসা নিয়ো, পাঠায়ো তোমার বই
মন ভালো নেই, লিখিতে পারিনা, এখন বিদায়লই।
গ) চিঠি জওয়াব ঃ
এত দিন বুজি কেটে গেল খরোতরো দুর্দিন?
আবার বাহুতে বাজ বন্ধু, পায়ে মল নিবে রিণিঝিনি।
আবার জারাবে সুঠামতনুতে টিয়া ঠোঁট পাড়শাড়ী
এক গাল পান মুখে দিয়ে যাবে বেড়াইতে ওই বাড়ী?
সেখানে নতুন মাষ্টার বউ এসেছে ক মাস হল
বড় ভালো বউগ্রাম মাঝে তার তারিয়া উঠেছে দলও।
ঘ) আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে উড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন সেই বয়সে কলের জাহাজ চালাও গগণ জুড়ি
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু, সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন পরী দেও -দানা
পাতাল পুরির অজানা কাহিনী তোমরা শুনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
যে ক’জন মুসলিম নারী লেখকের অবদানে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, সুফিয়া কামাল তাদের অন্যতম প্রভাবশালী। ত্রিশ উত্তর কবিদের কালে অভিভূত হয়েও তিনি উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব এক কণ্ঠস্বর। তার পথ ছিল একান্তই সহজ-সরল নিরাভরণ এবং ¯িœগ্ধময়। সামাজিক অসম্য অবিচার আর শোষণের বিরুদ্ধে ছিল তার অবিচল অবস্থান। দীর্ঘ ৭০ বছরের কাব্য জীবনে সুফিয়া কামাল কেবল কাব্য চর্চাই করেননি বরং কবিতার রাজপথ ধরেই হয়ে উঠেছিলেন আমাদের আশা- আশ্বাস আর ভরসার প্রদীপ্ত এক উৎস। বস্তুত আমাদের জাতীয় জীবনে সুফিয়া কামাল এক প্রতিষ্ঠানের নাম সামাজিক অগ্রগতির ও নারী জাগরণের সংগ্রাম, অপরাজয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক। তিনি মনে করেন নারী কোন অবলা জীব নয়, পুরুষের মনোরঞ্জন তার একমাত্র কাজ তাহা মনে করেন না। তিনি মনে করেন নারীর মধ্যে আছে অনন্ত শক্তি, সুযোগ পেলে সেও দেখাতে পারে বিশ্ব- বিজয়ী রুপ। এ ভাবনায় ছিল তার গভীর প্রত্যয়।
জাগো- মাতা-বধু
তোমার ঘরের মাটির প্রদীপ আলো
জেগে আছ মাগো, আর কটা দিন জাগো,
আর নেই দেরী গভীর রাত্রি শেষ হয়ে এল
এবার প্রভাত ফেরি।
শোনা যায় ওই পূর্ব অচলে প্রভাত রবির কর
দিগন্ত ব্যাপিয়া আধাঁর নামিয়ে অলিছে তিমির হয়
তোমার প্রাণের দ্বীপ্তিতে দ্বীপ জ্বেলেছে আধাঁর রাতে
আলজিরিয়ার মুক্তি আলোক জ্বেলেছে তোমার হাতে।
যে নারী কল্যাণী
জয়ামাতা গৃহিণ ীতুলনা বিহীন
কেহ তাহারে ভুলিবে না।
সুফিয়া কামাল নারীদের অন্দর মহল থেকে রাজপথে নিয়েএসেছেন। ধন্য হে মহিয়সী নারী, জানাই সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা। এই মহিয়সী নারী ১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে তিনি এই সম্মান প্রথম অর্জন করেন।
লেখক – নমিতা দাস, প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, রাজবাড়ী জেলা শাখা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়