“আমার দেখা, আমার বাবা”- মঞ্জুরা মোস্তফা –

- Update Time : ০৩:৪০:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ অগাস্ট ২০২১
- / ৩৪ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
আমার আব্বা ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফার ছোট খাট সাধারণ কিছু অভ্যাস, তাকে করেছিলো অসাধারণ। কচিগাছকে যেভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে একটা পূর্ণ গাছের রূপদান করা যায়, আব্বা ঠিক সেভাবেই আমাদের চিন্তা ও মননকে তাঁর অতি সুন্দর কিছু বৈশিষ্ট্যে বাঁধতে চেয়েছে।
একদিন আব্বার সাথে রিকশা করে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ি ফিরে আব্বা রিকশা ভাড়া দিলো। আব্বা সাথে থাকলে কখনও কোন অবস্থাতেই টাকা খরচ করতে দিতো না। তো যেটা বলছিলাম, আব্বা ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ দিয়েছে। আমি একটু অপেক্ষা করছি রিকশাওয়ালা আব্বাকে বাড়তি টাকাটা ফেরত দেবে বলে। আব্বা আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল,” চলো মা ভিতরে যাই। “
বললাম, “টাকা ফেরত নিবা না ? “
আব্বা খুব মিষ্টি হেসে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “মা,ওরা সবাই আমাকে চেনে। ওরা জানে আমি সব সময় ওদের বেশি দেই।”
আব্বার এমন কিছু অনন্য গুণ তাকে করেছিলো মোহময়।
যেমন আর্থিকভাবে দূর্বল রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেয়া, ঔষধ দেয়া।
খুব ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাড়ির রুমগুলোকে কখনও কখনও হাসপাতালের কেবিনের মতো দেখেছি।
আত্মীয় -স্বজন, পরিচিতজনদের অনেকেই চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসা – ঔষধের পাশাপাশি আমাদের বাড়ির ঘরগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। আম্মা কষ্ট করেছে। আমরা স্যাক্রিফাইস করেছি।
খুব কাছে থেকে দেখেছি, কিভাবে একটা মানুষের কাছে পরিবার, সমাজ, দেশ, ধর্ম সব কিছুই সাধ্য ও সীমার মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে।
দূর্বল, এতিম ও বঞ্চিতদের এক আশার জায়গা ছিলো আব্বা।
জীবনে কোনদিন কোন সাহায্য প্রার্থীকে, তা যে ক্ষেত্রেই হোক, আব্বার কাছ থেকে বিমুখ হতে দেখিনি।
দু/একটা ঘটনার কথা না বললেই নয় –
আমাদের বাড়ি ১ নং বেড়াডাঙ্গার সামনে যে খেলার মাঠটা রয়েছে তার পিছনেও আছে আব্বার অবদান।
ওই মাঠটা কিছু ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের দ্বারা জবর দখলের চেষ্টা চলেছিলো এক সময়। আব্বা তখন তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাদের বলে, “আমার এলাকার ছেলেরা এই মাঠে খেলবে। থাকবে অভিভাবকদের চোখের আওতায়। মাঠ না থাকলে তারা খেলাধুলা বাদ দিয়ে আড্ডাবাজি করবে। খারপ পথে পরিচালিত হতে পারে।”
তরুণ সমাজকে নিয়ে কি অসাধারণ -ই না ছিল তার দৃষ্টি ভঙ্গি, চিন্তা চেতনা।
আব্বা ছিল একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। দেশের যে কোন ভালো খবরে তাকে আপ্লুত হতে দেখেছি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজবাড়ির মাটিপাড়া অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তথ্য আদান প্রদানের জন্য তাকে ১৪ই ডিসেম্বর হত্যার পরিকল্পনাও করা হয়। তাকে কৌশলে ডেকে নিয়েও যাওয়া হচ্ছিল। হাসপাতালের তৎকালীন সুইপার বিষয়টি পূর্বাভাগে জানতে পেরে তাকে রক্ষা করে। তিনি ছিলেন এই পবিত্র মাটির গর্বিত সন্তান – একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
পুত্রহীন চার কণ্যা সন্তানকে তিনি দিয়েছিলেন শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠার মন্ত্রপাঠ।
বলতো,”এ জীবনে যার আইডেন্টিটি নাই, তার মতো দূর্ভাগা আর নাই। “
আব্বা ছিলো বিবিধ গুণ ও যোগ্যতার সমন্বয়ে গঠিত এক অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় চুম্বাকর্ষক ব্যক্তিত্ব।
শিক্ষা, জ্ঞান পিপাসা,সুরুচি, সৌজন্য, মানবিকতা এসব ছিলো তার চর্চার বিষয় যা তাকে করেছিলো প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার এক সাদা মনের মানুষ।
সততা ও নীতি আদর্শে এক সুদৃঢ় পাহাড়। আসলে, আব্বাকে নিয়ে বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না।
আব্বা ছিলো আমাদের পরিবারের আলোক বর্তিকা। হ্যা, আলোক বর্তিকাতো বটেই।
এই পরিবারে সে ছিলো সূর্যের মতো তেজোদ্দীপ্ত শক্তি।
রবির কিরনমালার মতো তার আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হতো আমাদের চলার পথ।
আজ আব্বার চলে যাওয়ার এক বছর হলো।
তার আগুনের পরশ মনির সেই অমীয় উষ্ণতা ও উত্তাপের অভাব সুতীব্রভাবে অবুভব করছি।
উল্লেখ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফা ছিলেন, রাজবাড়ী জেলা বিএমএ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। তিনি ২০২০ সালের ৮ই আগষ্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন।
লেখক – মঞ্জুরা মোস্তফা ( ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফার দ্বিতীয় কন্যা), সহকারি অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়