করোনার কাছে হেরে যাওয়া রাজবাড়ীর বনি’র গল্প: ফ্রান্স প্রবাসী ডাক্তার হাবিবা জেসমিন!-

- Update Time : ০৮:২৯:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ মে ২০২০
- / ৫০ Time View
ডাক্তার হাবিবা জেসমিন:
প্রতিটি মৃত্যুই আমাকে ভেঙে চুড়ে ফেলে, আর গতকাল যে বনি মারা গেল ওর জন্যে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে ওর মা বাবার জন্যে,এই বাবা মা কিভাবে এতো ভারী বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকবে এটা ভেবে, (হে আল্লাহ আপনি উনাদের এই কষ্ট সহ্য করার তৌফিক দান করুন, আমীন) এই লেখা আমার অতিরিক্ত এলোমেলো ভাবনা থেকে।
বনি কে আমি যখন প্রথম দেখি তখন ওর বয়স ১০/১১,রাজবাড়িতে, আনন্দে উচ্ছলতায় পরিপূর্ণ একটি বাচ্চা মেয়ে, ও আমার দুলাভাইয়ের (ননাসের হাজবেন্ড) আত্মীয়া, সেই সুবাদে ঐ বাসায় আমাদের দাওয়াত, তখন ওর বাবা খলিল ভাই ফ্রান্সে, ওরা তখন ও দেশে, ঐ বিশাল বাড়ির তিন রাজকন্যার এক আদুরে রাজকন্যা ও, তারপর দিন গড়িয়ে গেল, বনি মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ওর ভাই হিমেল কে নিয়ে ফ্রান্স আসলো, ওদের মা ভিসা জটিলতায় আসতে পারেননি, তখনই এই বাচ্চা গুলোর উপর আমার মায়া পড়ে গেল, হিমেলের তখন ৮/৯ বছর, মা ছাড়া বাচ্চা গুলো, যারা বাবাকে ও খুব একটা কাছে পায়নি, ওদের বাবা সবসময়ই দেশের বাইরে ই ছিল। মাঝেমধ্যে ওদের সাথে দেখা হয় , আমি খলিল ভাই কে বললাম এখানে যেহেতু ভাষার একটা জটিলতা আছে তাই বনিকে ভাষা শিখিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে আর যদি তা না পারে তাহলে অন্য কোনও ডিপ্লোমা নিতে যাতে সে কাজ করতে পারে, সেটা আমি বনি কেও বুঝিয়ে বলেছিলাম, আমি আমার আব্বার মতোই সেই মতবাদে বিশ্বাসী আগে মেয়েদের নিজের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করতে হয় এবং সেটা নিজেকে যোগ্য করে, এর দুই তিন বছর পর শুনলাম ওরা দেশে গেছে ও বনির খুব ভাল বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে ইন্জিনিয়ার, আমার একটু রাগ হলো, এটা শুধু ওদের উপর নয় যারা এধরনের কাজ করে তাদের উপরই আমার রাগ হয়, তারপর আবার আমার সাথে বনির দেখা, আমি আবারও বললাম মা ভাষাটা শিখে একটা কাজে ঢুকতে, ও জানালো ও দুবাই চলে যাবে কারণ ওর হাজবেন্ড দুবাই থাকে। এবার আর কিছু বললাম না কারণ জীবন যার সে তার ইচ্ছামতো চালানোর অধিকার রাখে, আমাদের বলার দরকার আমরা বলি। এরপর ও আমি বললাম, এখানকার রেসিডেন্স কার্ড যেন কোনো ভাবেই নষ্ট না করে।
মাঝে কিছু সময় বয়ে গেল, তখন একদিন খবর পেলাম হিমেল অসুস্থ, ধরা পরলো ব্রেইন টিউমার ( মেলিগন্যান্ট), তখন আমি ওদের আপন চাচীর ভূমিকায় গেলাম কারন ওদের বাবা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পরলো তারপর ভাষা জটিলতা ও আছে, আবার হিমেলের বয়স ও ১৮ র নীচে, এখানে নিয়ম ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া এবং রোগীর পারমিশন ছাড়া ডাক্তার রা রোগীর রোগ সম্পর্কে কোনো ইনফরমেশন কাউকে দিতে পারবে না। তখন বনি, ভাইয়ের অবস্থা শুনে দুবাই থেকে আসলো। তখন ওর সাথে প্রায়ই কথা হয়, দেখা হয়, তখন জানলাম ওর বাচ্চা হওয়া নিয়ে সমস্যা, ও কনসিভ করে কিন্তু ৪/৫ মাসের মাথায় সেটা মিসক্যারেজ হয়ে যায়, বনি ভাল নেই এটাও আমার মনে হলো, আমার কাছে মনে হয়েছে ওর যে গোবরে পদ্মফুলের কাছে বিয়ে হয়েছে সেই পদ্মফুল দুর থেকে অনেক সুন্দর কিন্তু কাছে গেলে গোবরের গন্ধ পাওয়া যায় ।এটা একান্তই আমার নিজের ধারণা, এ ব্যাপারে ওর ফ্যামিলি কিছুই আমাকে বলূনি, ওকে দেখে ওর সাথে কথাবার্তা বলে আমার এমন ধারণা হয়েছে, কারন আমরা তো বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসি বনির সাথে আমার শেষ দেখা গত নভেম্বরে, আমার বাসায় এসেছিল বাবা আর ভাইকে নিয়ে, অনেক কস্ট করে এসেছিল আমার বাসায় কারন তখন ফ্রান্সে ট্রান্সপোর্ট ধর্মঘট ছিল। তখন বনিকে দেখে মনে হলো শান্ত একটা দিঘী, আমি কথা বলছিলাম ও মিষ্টি মিষ্টি হাসছিল, আমি ওদের সাথে অনেক কথা বলেছিলাম, তখন আমি বনিকে বললাম পরেরবার ও যেন কনসিভ করার সাথেই এখানে চলে আসে, আমার পরিচিত ডাক্তার আছে যারা শুধুই প্যাথলজীক্যাল প্রেগন্যান্সী নিয়ে কাজ করে, আমি আগেই কথা বলে রাখব, আমার কলিগরাও এদের চিনতো কারন ওর ভাই যখন অসুস্থ ছিল আমি কলিগদের সাথে এদের নিয়ে গল্প করতাম, মন খারাপ করতাম। ও বলল ঠিক আছে।
মাঝখানে ওর বাবা আর ওর ভাই দেশে গেল, ও দুবাই থেকে দেশে গেল, বাবা, ভাই ফ্রান্স চলে আসলো মার্চে।
কয়েকদিন আগে খলিল ভাই টেলিফোনে বললো বনি ঢাকা আনোয়ার খান হাসপাতালে ভর্তি, পেট ব্যাথা নিয়ে, তখনই জানলাম ও আবার ৫/৬ বারের মতো প্রেগন্যান্ট, তখন বুঝলাম ওর হয়তোবা কনট্রাকশন হচ্ছিল তাই হাসপাতালে এডমিট রাখা হয়েছিল, ফলো আপ এর জন্য, খুবই ভাল কথা কিন্তু সমস্যা হলো মাঝখানে আনোয়ার খান হাসপাতালের একজন ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেল, বনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৫ দিনের মাথায় সবাইকে রেখে চলে গেল। মারা যাওয়ার ৭/৮ দিন আগে থেকে ওর জ্বর ছিল, একদিন খলিল ভাই টেলিফোন দিল ও বললো, বনির করোনা পজিটিভ, হাসপাতাল এখনই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিতে চাচ্ছে কারণ এখানে করোনা রোগী তারা রাখে না তখন বনির আত্মীয় স্বজন রা সারারাত ঢাকা শহরের হাসপাতালে ঘুরল কিন্তু পেল না, বাধ্য হয়ে তারা থানায় গেল, থানা থেকে তখন হাসপাতালে ফোন দিল ঐ থানার ওসি সাহেব, উনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কে বললো রোগীকে যদি এভাবে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে ঐ হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তখন তারা হাসপাতালেই রাখলো কিন্তু প্রথম দুইদিন কোনো আত্মীয় স্বজন কে দেখা করতে দিলো না যেটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু অস্বাভাবিক হলো কোনো ডাক্তার নার্স রোগীর কাছেও আসলো না। পরে বললো রোগীর অবস্থা খারাপ তাই তারা আই সি ইউ তে রেখেছে, তখন বনির খুব শ্বাস কষ্ট। ও একদিন ওর বাসায় ফোন দিয়ে বললো ওর অক্সিজেন শেষ, ও দম নিতে পারছে না, ওর কাছে কেউ আসেও না যে সে বলবে, তখন বনি ও মনে হয় বুঝলো ওর সময় শেষ, ও সবার কাছে মাফ চাইলো।করোনা পজিটিভ হওয়ার ৭দিনের মাথায় ও চলে গেল।
এখন আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ঐ দিনগুলো তে ডিউটি তে কারা ছিল ( ডাক্তার, নার্স) আপনারা কি মেয়েটির ফ্যামিলি হিস্ট্রি জানতেন না? কেন ওকে এতো অবহেলা করা হলো, ও তো করোনা পজিটিভ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল না, ও হয়তোবা হাসপাতাল থেকেই এটা পেয়েছে কারন ওর ফ্যামিলির কারো করোনা পজিটিভ আসেনি। তাহলে এই যে অবহেলা আপনারা করলেন তার জবাবদিহিতার জন্য এই পরিবার আর যাবে না আপনাদের কাছে কিন্তু উপরওয়ালার কাছে কি জবাব দিবেন? জবাব তৈরি করে রাখেন, দিতে হবেই হবে। যারা ধর্ম মানে না তারাও বলে প্রকৃতি বিচার করবে। ওর মৃত্যু করোনায় লেখা ছিল, সেটা হতোই, কিন্তু এতো গাফিলতি এতো ধাক্কা ধাক্কিতে কেন? হয়তো বলবেন এটা ও ওর কপালে লেখা ছিল। না, এটা ঠিক না, তাহলে আমরা অসুখ হলে চিকিৎসা না নিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে ঘরেই বসে থাকতাম! একটা মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখন যে সে কতোটা অসহায় হয়ে পরে এবং ডাক্তারদের কাছে কতোটা নিজেকে সপে দেয় আল্লাহর পরে সেটা আপনি, আমি সবাই জানি। আমরা ডাক্তার রাও করি।
আর এই যে দেশের সন্মানিত ধনীরা, ক্ষমতাবানেরা আপনাদের যারা জীবিত আছেন তাদের বলছি, আজ এই যে আপনাদের জ্ঞাতী ভাইয়েরা কাতারে কাতার মারা যাচ্ছে, আপনাদের বিবেক বিবেচনা কে কি জাগ্রত করতে পেরেছেন?? এই যে আপনারা আঙ্গুল গরম হলেই আমেরিকা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, হিল্লি দিল্লি দৌড়াতেন, এখন কোথায় যাবেন? এখন মাউন্ট এলিজাবেথের পায়ের গোড়ায় ঢেলে দেন তো মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার, নেয় নাকি!! আপনারা যদি দেশে চিকিৎসা নিতেন, তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কিভাবে আরও উন্নত করা যায় আপনারা ও ভাবতেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট আরো বরাদ্দ হতো। উন্নত মেশিন আসত দেশে, সেগুলো পরিচালনার জন্যে বাইরে থেকে ডাক্তার দের ট্রেনিং দিয়ে আনা হতো, ডাক্তারদের আপনারা হুকুমের চাকর না ভেবে, উনাদের কাজ উনাদের করতে দিতেন, দেশের বাইরে গেলে যেরকম হোন দেশের বাইরের ডাক্তারদের সাথে, দেশের ডাক্তার দের সাথে তেমনই আচরণ করুন। আর এসব কিছুর কারনে দেশেও একদল চামচা ডাক্তার গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে যারা শুধুমাত্রই ধনীদের ডাক্তার এখনও সময় আছে ভাবার, আমার মনে হয় আমরা যারা নিজেরাই নিজেদের দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়েছি সেই দেশের চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বাজেট!! কি হাস্যকর না!??
যাকে নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম তাকে দিয়েই শেষ করি, বনি মা আমার, তুমি অনেক ভাগ্যবতী, কি সুন্দর একটা সময়ে তুমি চলে গেলে, দিনটি ছিল শুক্রবার, রোজার মাস, মহামারির সময় এবং অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়, আমরা আশা করছি মহান রাব্বুল আলামিন তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করবেন (আমিন) তোমার মা, বাবা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন নামাজ এর দোয়ায় থাকবে তুমি। তুমি খুব বাচ্চা পছন্দ করতে, তুমি তো তাদের তোমার সাথে নিয়েই গেছ। এই দুনিয়ার আর কেউ তোমাকে আঘাত, অবহেলা কোনোটাই করতে পারবে না। তুমি সব কিছুর উর্ধ্বে এখন। আল্লাহ তোমাকে এই নোংরা হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে আর রাখতে চাননি তাই উনি তোমাকে নিয়ে গেছেন। ঐ দুনিয়ায় ভাল থেকো মা।
লেখক –
ডাঃ হাবিবা জেসমিন (মিমচা মিঃ ২৪ ব্যাচ) এখন কর্মস্থল, হাসপাতাল ল্যাম্পেরিয়ার, ফ্রান্স।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়