প্রীতিলতার আত্নহুতি দিবস : লেখক- শারমীন রেজা লোটাস
- Update Time : ১০:১৩:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ১৮৯ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
“স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে পারব, প্রাণ নিতেও মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না” এই উক্তিটি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মরণীয় নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের।
আমরা জাতি হিসেবে আজ স্বাধীন। কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। অনেক চড়াই-উৎড়াই পার করে আজ আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে দেশভাগের আগ অবধি দীর্ঘ ২০০ বছর আমরা ব্রিটিশদের শাসনাধীন ছিলাম। তখন ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছেন অসংখ্য তরুণ-যুবক। বহু স্বাধীনতাকামী ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য নির্ভীক চিত্তে অত্যন্ত আনন্দের সাথে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
তেমনই এক স্বাধীনতাকামী অগ্নিকন্যার নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার প্রথম নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের চাটগাঁতে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ শেষে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। প্রীতিলতার ডাক নাম ছিল রানী। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী এবং মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার দেশপ্রেমী গৃহিণী।
রানীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণী থেকে। প্রতি শ্রেণীতে প্রথম তিন স্থানের একটি অর্জন করায় রানী সবার স্নেহ ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। শিক্ষিকা উষাদির দেয়া ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাই বই পড়ে প্রীতিলতার হৃদয়ে বিপ্লবী চেতনা জেগে উঠে। চট্টগ্রাম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বিজনের কাছ থেকে নিয়ে প্রীতিলতা ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, বাঘা যতীন, দেশের কথা ইত্যাদি বইগুলো পড়েন। চাচাতো ভাই অমৃত সুদানের মাধ্যমে তিনি বিপ্লবী রাজনীতির খবরাখবর শুনতেন। ইংরেজ শোষক ও শাসকদের তাড়াবার জন্য ১৯৫৭-তে নাটোরের রানী ভবাণীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শোনার পর ভাইকে বলেন আমারও ইচ্ছে করে এদের মত হতে। দেশের স্বাধীনতার জন্য ওরা যদি লড়তে পারে আমি কেন পারব না? তাছাড়া তোমরা তো সবাই আমাকে রানী বলেই ডাকো। নাটোর আর ঝাঁসীর রানী পেরেছিল, চাটগাঁর রানীও পারবে। সে ভাইকে বিপ্লবী দলে যোগ দেয়ার ইচ্ছের কথা বলে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা যেসব কর্মসূচী নিয়েছিলেন, তারমধ্যে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ অন্যতম ছিল। তরুণ বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ আক্রমণ ব্যর্থ হয়, ব্যর্থতার বেদনা সহ্য করতে না পারায় শৈলেশ্বর চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে। অতঃপর সূর্যসেন সিদ্ধান্ত নেন আক্রমণের দায়িত্ব একজন নারীকে দেবেন, তিনি বলেছিলেন বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নেই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ কালারপুল পর্যন্ত এদের দীপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে- শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজাত জানুক, এ দেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছনে নেই”।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেন এবং জানিয়ে দেন তোমার নেতৃত্বে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত্রিতে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে। আক্রমণের পূর্বে কয়েকদিন পর্যন্ত প্রীতিলতা তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে অস্ত্রশিক্ষা নেন। অবশেষে ঠিক করেন ২৩ সেপ্টেম্বর রাত্র দশটায় ক্লাব আক্রমণ করবেন। সিদ্ধান্তানুযায়ী প্রীতিলতা তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ক্লাবের বাবুর্চির সংকেত পেয়ে রিভলবারের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায় গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে। উদ্দাম বিদেশী দল নৃত্যের মধ্যে নেমে এলো মৃত্যুর হাহাকার আর ধ্বংসলীলা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রীতিলতা তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করে হুইসেল দিয়ে সকলকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন। সকলকে সামনে পাঠিয়ে ক্লাবের বাইরে নালার পাশ দিয়ে প্রধান সড়কে ওঠে। ঐ পথ গিয়ে মিলেছে রেলের ওভার ব্রীজে এবং সেটা পার হয়ে গেলে পাহাড়তলী বাজার। এমন সময় নালার মধ্যে থেকে একটি গুলি এসে প্রীতিলতার বুকে লাগতেই তার রক্তাক্ত দেহ রাস্তার ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে। রক্তস্রোতে প্রীতির স্বাভাবিক পোশাক ভিজে সামরিক পোশাকও রক্তরঞ্জিত হয়ে উঠে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে যন্ত্রণাকাতর প্রীতিলতার মনে হল, এমন আহত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। প্রীতিলতা তার পকেট থেকে বিষের মোড়কটি খুলে নিজের মুখের মধ্যে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দেহ তার হয়ে যায় নিথর নিশ্চল।
সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় এবং মনে জন্ম নেয় অজস্র প্রশ্ন।
তবে সূর্যসেনরা ডাকাতির মামলা থেকে রাতারাতি খালাস পেয়ে যায়। বাধ সাধে ১৯২৪ সালের ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামের এক জরুরি আইন। এই আইনের আওতায় বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু হয়। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনাসমূহ বাজেয়াপ্তঘোষণা করে। একারণে তখন বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্রগোপনে রাখার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রীতিলতার খুড়তুতো দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারও তখন সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্তমোড়কে মোড়া কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রেখে যান এবং বইগুলি লুকিয়ে রাখার জন্য বলে যান। প্রীতিলতা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। দাদার আদেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা বইগুলো লুকিয়ে রাখেন ঠিকই, কিন্তু ওগুলোতে কী আছে তা জানার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। অদম্য কৌতূহলের কারণেই একদিন মোড়ক খোলেন এবং লুকিয়ে গোগ্রাসে একে একে পড়ে ফেললেন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’-এর মতো নিষিদ্ধ সব বই।
বইগুলো পড়ে ভীষণভাবে আলোড়িত হন প্রীতিলতা। মূলত এগুলোই তাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। তখন তিনি পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার ইচ্ছের কথা বলেন। কিন্তু তখনও পযন্ত বিপ্লবী দলে কোনো নারী সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্যকোনো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিল। প্রীতিলতা দাদাকে বলেন, “এতকাল আগে থেকে মেয়েরা যদি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়তে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? তোমরা সবাই তো আমাকে রাণী বলে ডাকো। নাটোর আর ঝাঁসীর রাণী যা পেরেছিল, চাটগাঁর রাণীও নিশ্চয়ই তা পারবে।”
কিন্তু পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁর ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেননি। বরং বলেছিলেন, মেয়েরা যুদ্ধ করতে পারবে না, মেয়েরা বড়জোর বইপত্র লুকিয়ে রাখার মতো কাজে আড়াল থেকে স্বাধীনতাকামীদেরকে সহযোগিতা করে যাবে। কিন্তু প্রীতিলতা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না, কেন তার দ্বারা যুদ্ধ করা সম্ভব না?
এরপর মাস্টারদা ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফের ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এই আক্রমণের দায়িত্ব এবার তিনি নারী বিপ্লবীদের দেবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ে গেলেন। এবার আক্রমণের নেতৃত্বের ভার নিতে চাইল একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা। সদস্য সংখ্যা হলো ১৫ জন। ২৩ সেপ্টেম্বরের সে আক্রমণে দিন প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধূতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেওয়ার জন্যে মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা।
বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভেতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫-এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘনঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। যেন পাহাড়তলীতে কেঁপে উঠেছিল খোদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু সহযোদ্ধাদের সাথে আক্রমণ চালিয়ে যান। এরপর প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে দলের সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। কিন্তু আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন এবং যারা আহত হয়নি সেসব বিপ্লবীদের দ্রæত স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিপ্লবীরা সবাই স্থান ত্যাগ করেন।
প্রীতিকে সায়ানাইড ক্যাপসুল দেবার জন্য সবসময়ই অনুশোচনা করেছেন সূর্যসেন। কল্পনাকে পরে তিনি বলেছিলেন, “প্রীতি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিল দেশবাসীর কাছে শুধু এটাই প্রমাণ করার জন্য যে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে এবং জীবন দিতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, বেঁচে ফিরে আসলেই বরং সে আরো বেশি কিছু করতে পারত।”
প্রীতিলতার মৃত্যুর দিনটি ছিল ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে মাত্র ২১ বছর ৪ মাস ১৯ দিন বয়সে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন তিনি। আজকের এই দিনে বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধাভরে তাকে আমরা স্মরণ করছি।
লেখক – শারমীন রেজা লোটাস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, রাজবাড়ী জেলা শাখা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়