সংগ্রামী নারী মর্জিনা, যৌনকর্মী থেকে এনজিওর নির্বাহী পরিচালক –
- Update Time : ০৬:০১:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ মার্চ ২০২২
- / ১৮ Time View
রুবেলুর রহমান, রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
মর্জিনা বেগম (৫৬)। দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে আজ মুক্তি মহিলা সমিতি (এনজিও)র নির্বাহি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। পেয়েছেন জয়ীতাসহ বিভিন্ন সম্মাননা।
মর্জিনা বেগমের অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও সততা ও নিজের দক্ষতা দিয়ে ৪টি বিদেশি দাতা সংস্থার কাছ থেকে অর্থের যোগান এনে রাজবাড়ী গোয়ালন্দ দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর অসহায় নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন।
এদিকে দৌলতদিয়া মুক্তি মহিলা সমিতির ভবনে সংগঠনটির নিয়োগপ্রাপ্তরা শিশুদের মাতৃস্নেহে পাঠদান ও নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ । এতে প্রায় ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এখানে রয়েছে ডে কেয়ার, নাইট কেয়ার ও চাইল্ড ক্লাব। নারীদের কম্পিউটার, সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
জানাযায়, মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিন সন্তানের জনকের সঙ্গে বিয়ে হয় মর্জিনার। বিয়ের পর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ফরিদপুর তার নানা বাড়ীতে ফিরে অাসে। এবং সেখানে তিনি পিঠার দোকান দেন। ওই সময় এক দালাল তাকে সিরাজগঞ্জের পতীতাপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। ১৯৮৮ সালে সিরাজগঞ্জ থেকে তিনি দৌলতদিয়া পতীতাপল্লীতে অাসেন। এবং ১৯৯৫ বা ৯৬ সালের দিকে কেকেএস এর সাথে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে পল্লীর অসহায় নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করার লক্ষে ১১ জনের সমন্ময়ে মুক্তি মহিলা সমিতি গঠন করেন। সংগঠনটি ১৯৯৯ সালে সমাজসেবা, ২০০৯ সালে এনজিও ব্যূরো এবং ২০১৮ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন পায়।
এদিকে ২০০৯ সালে সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন পাবার তিনি নিজেই বিদেশি সেভ দি চিলড্রেন, সেভেন মোজিজ, মুসলিম চ্যারাটি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অর্থ যোগান এনে যৌনপল্লীর অসহায় নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন পর্যন্ত তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক, বিভাগীয, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের জয়িতা সম্মাননা, কবি নজরুল সম্মাননা, স্বাধীনতা সংসদ সম্মাননা, শেরেবাংলা স্বর্ণপদক, সমাজ সেবায় বিশেষ অবদান রাখায় সম্মাননা পান। বর্তমানে মুক্তি মহিলা সমিতির মাধ্যমে তিনি যৌনপল্লীর প্রায় ১৬০জন শিশুকে মাতৃস্নেহে পাঠদান ও বহু যৌনকর্মীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।
রাজবাড়ী গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া দেশের বৃহত্তর যৌনপল্লী হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় ১ হাজার ৩শ`র বেশি যৌন কর্মী রয়েছে। এছাড়া পল্লীতে যৌনকর্মী ও শিশুসহ প্রায় ২ হাজার বাসিন্দার বসবাস। মাঝে মাঝে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভালো চাকরি বা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশোরীদের এনে বিক্রি করা হয়। পরে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক তাদেরকে যৌন পেশায় লিপ্ত করা হয়।
দৌলতদিয়া মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহি পরিচালক মর্জিনা বেগম বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের চেষ্টায় অাজ তিনি সফল। বর্তমানে পল্লীর শিশুরা যাচ্ছে স্কুলে এবং নারীরা কিছুটা হলেও পাচ্ছে স্বাধীনতা । অাগে অনেক বাধ্যবাধকতা ছিল। যৌনকর্মীদের মৃত্যু হলে নদীতে ভাসানো হত। কিন্ত এখন তাদের মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতিনীতি অনুয়ায়ী জানাযা করে দাফন করা হয়। অার এসব সম্ভব হয়েছে যৌনপল্লী নিয়ে কাজ করা তার মত বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, পল্লীতে যারা থাকে তারা মানসিক ভাবে অসুস্থ। কারণ একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীসহ অনেক থাকে। কোন ঝামেলা হলে সবাই মিলে সমাধান করে। অার এখানে সে নিজে সংগ্রাম করে বেচে অাছে। সমাজের অন্যদের চেয়ে অালাদা যৌনকর্মীরা, কিন্তু কেন? শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, নারীরা সঠিক চিকিৎসা পায় না। এবং মারা গেলে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হতো। তিনিও যৌনকর্মীদের একজন ছিলেন। তখন থেকেই তিনি ভাবতেন সুযোগ পেলে যৌনকর্মী ও নারীদের নিয়ে কাজ করবেন। ওই সময় সেভ দি চিলড্রেন ও কেকেএস যৌনপল্লীতে কাজ করতে অাসে। তখন তাদের সঙ্গে ফিল্ড পর্যায়ে কাজ শুরু করেন। সেই ফিল্ড থেকে অনেক নির্যাতন সহ্য করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছারাই সততা, পরিশ্রম ও জ্ঞানকে পুজি করে অাজ এ পর্যায়ে এসেছেন। অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তিনি অারও বলেন, শুরুর সময় কেকেএস এর সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করেন। যখন তার মুক্তি মহিলা সমিতি ২০০৯ সালে এনজিও ব্যূরোর রেজিস্ট্রেশন পান, তখন থেকে তিনি সরাসরি বিদেশি অর্থ দাতাদের সাথে কাজ শুরু করে। অনেক সংগ্রাম ও নির্যাতন সহ্য করে অাজও টিকে অাছেন। এখন তিনি সফল । তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধমে সরকারকে জানায়, যে এরকম একটি জনগোষ্ঠী দেশে বসবাস করে। অাজ তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে সরকারও জেনেছে। যার ফলে এখন যৌনকর্মীরা সরকারী সহযোগিতা পাচ্ছে। করোনার সময় ডিঅাইজি হাবিব স্যারসহ অনেক সংস্থা সহযোগিতা করেছে। এখন পল্লী থেকে ৩০ থেকে ৩৫জন মা বেড়িয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। কিন্ত থাকার জায়গা না থাকায় ফিরতে পারছেন না। এদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
রাজবাড়ীর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ অাজমীর হোসেন বলেন, এবার নারী দিবস উদযাপনে র্যালী ও অালোচনা সভার পাশাপাশি তিনটি কলেজের ২০ জন দরিদ্র এবং মেধাবী ছাত্রীকে ১ হাজার করে মোট ২০ হাজার টাকা দেবেন। নারী নের্তৃত্বে দৌলতদিয়ার মর্জিনা অাপা একজন অাইডল। তিনি রাজবাড়ী বাসীর গর্ব এবং জেলার শ্রেষ্ঠ জয়ীতা। তিনি শুধু জেলা না, সারাদেশের নারীদের অাইডল। ওনার কর্মকান্ড তুলে ধরতে পারলে দেশের নারী সমাজ অারও এগিয়ে যাবে ।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়