“সত্যেন সেন এক মহাপ্রাণ” – লেখক : ডাঃসুনীল কুমার বিশ্বাস –
- Update Time : ১০:১৬:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ নভেম্বর ২০২১
- / ২১ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা তিন পকেটের খদ্দরের কুর্তা,লম্বা অবয়বের ঢিলা ঢালা পায়জামা পায়ে পুরনো স্যান্ডেল, দ্রুত লয়ে হেঁটে চলেছেন পুরান ঢাকার সদরঘাট, বাংলা বাজার কিংবা বংশাল। হঠাৎ তাঁকালে যে কেউ আঁতকে উঠবেন, একদিন নয় প্রতিদিন, তিনি কে হতে পারেন? তিনি আর কেউ নন সবার প্রিয় সত্যেন সেন। যখন শিশুর মত সরল হাসিতে মুখটা ভরে ওঠে মনে হয় চিরচেনা একজন, এই সাধারন অবয়বের মধ্যে বাস করেন মানুষ এক অসাধারণ।
বিশ শতকের বিশ ত্রিশ দশকে বিপ্লবী যুগে অস্ত্র;গুলি বোমা নিলেন হাতে, ছাত্র জীবনেই যুগান্তর সন্ত্রাসী দলে যোগ দিলেন, সে পথে না এলো বিপ্লব-না এলো স্বাধীনতা, যুবক সত্যেন লেগে গেলেন কৃষক-শ্রমিক জাগানোর কাজে- মার্কস লেনিনের পথ হলো তাঁর নতুন পন্থা। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ পরাস্ত করতে পথে নেমে গেলেন । কাস্তে-হাতুড়ি,তুলি, কলম, তবলা, হারমোনিয়াম এক করার কাজে মনোযোগী হলেন, প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ গড়ে তোলার অন্যতম সহায়ক হলেন সত্যেন সেন। ত্যাগ করলেন সন্ত্রাসী যুগান্তর দল, ১৯৪২ সালে প্রগতিশীল বিপ্লবী সোমেন চন্দকে প্রকাশ্য দিবালোকে ফ্যাসিবাদী গুন্ডারা হত্যা করেন, ১৯৩১ সালে রাজনৈতিক কারণে সত্যেন সেন প্রথম কারাবরণ করেন এবং ৩ মাস পর ছাড়া পেলেন। ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন। এ সময় তিনি ৬ বছর কাল একনাগারে কারাগারে কাটান। ১৯৩৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পেলেন। তার আত্মীয়স্বজন বিশেষ করে তাঁর কাকা বিশ্ব ভারতীর তৎকালীন উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের প্রচেষ্টায় তিনি বাংলা ভাষায় উচ্চতর গবেষণার জন্য বৃত্তি পেলেন। তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং মার্কসবাদকে জীবনের ধ্রুবতারা মেনেই মেহনতি মানুষের মুক্তি ব্রতে নিজেকে সঁপে দিলেন, সাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আহ্বান, আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ উপেক্ষা করে- তিনি সোনারং গ্রামে ফিরে গেলেন। তিনি গ্রামের কৃষক আন্দোলনে যোগ দিলেন। ৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর ৪৭ এর দেশ বিভাগ ভেঙ্গে দিলো অনেক তরুণের স্বপ্ন, তাঁরা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন -যাতে মানুষের মুক্তি সংগ্রাম না হয় ক্ষুন্ন। অত্যাচার নিপীড়ন, নির্যাতন স্তব্ধ করতে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, তাঁরা বুঝতে পারলেন ঐক্য আর সংগ্রাম ছাড়া এ আকাঙ্ক্ষা হবে না পূরণ। দেশ প্রেমিকদের স্থান হল চার দেয়ালের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে- সত্যেন সেন ও বন্দী হলেন, কি আশ্চর্য! এই নতুন আবাস তাঁকে রূপান্তরিত করে নতুন এক সত্যেন সেন। তিনি নয়া ধ্রুপদী কথা সাহিত্যিক রূপে আবির্ভূত হন। ১৯৪৩ সালে মহাদুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় কৃষক সমিতির মাধ্যমে রাখলেন এক অসামান্য অবদান।
উপমহাদেশের জাতীয় মুক্তি ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বদাই যুক্ত থেকেছেন। যাঁরা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানে নিরন্তর যুক্ত থেকেছেন সত্যেন সেন তাঁদেরই একজন, তাঁর বহুমুখী কাজের মধ্যে একটি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঝড়ের বেগে বাংলা ভাষায় নয়া ধ্রুপদী ধারার উপন্যাস ও গনচরিত্রের অালেখ্যমালার সৃষ্টি করেন। পদ্মা আর ধলেশ্বরীর বিপুল জলধারায় অালিঙ্গিত ঐতিহাসিক বিক্রমপুরের সোনা রং গ্রামের এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তান সত্যেন সেন, তাঁর জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮শে মার্চ – তাঁর ডাকনাম ছিল লস্কর, তার পিতার নাম ধরণী মোহন সেন- মাতা মৃণালিনী সেন, পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর কাকা বিশ্বভারতীর উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেন, অার দাদা ছিলেন জিতেন্দ্র মোহন সেন(শংকর) তার ভাগ্নে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ত্রিশের দশকের শুরুতেই শুরু হয় তাঁর পলাতক জীবন , মাহাঙ্গু বানিয়া (বাউ) তাঁর ঠাকুর মার পালিত অবাঙালি পুএ এবং তাঁরপ্রথম রাজনৈতিক গুরু, তার মাধ্যমেই তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তিনি ছিলেন সকল বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রপথিক, একাধারে তিনি ছিলেন রাজনিতিক, কবি,সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক। তিনি চারণের মত গ্রাম বাংলার পথে পথে ঘুরেছেন, কৃষক-শ্রমিকদের কাছ থেকে অমূল্য সব তথ্য করেছেন চয়ন। তিনি ছিলেন সত্যান্বেষী সাহসী বীর অবিরাম চারন, তিনি নিজেই বলেছেন ” গ্রাম বাংলার পথে পথে ঘুরি, হারানো মানিক খুঁজে ফিরি ” পাক ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে পাক সরকার হুলিয়া জারি করেন, ১৯৪৯ সালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তাঁকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী গ্রেপ্তার করেন। আবার কারাভোগ করেন, কমিউনিস্টদের প্রতি নির্মম অত্যাচার আর চালায় অমানুষিক নির্যাতন, সত্যেনের উপরও কারা প্রশাসন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়, যার ফলে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও চোখের পীড়া দেখা দেয়। দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়ে নিজ গ্রাম সোনা রং এ ফিরে আসেন।
ঐ সময় নানা প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তাঁদের পরিবারের সবাই নিরাপত্তার কারণে কলকাতায় পাড়ি জমান, ১৯৭১ এ তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তবে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একপর্যায়ে তাঁর চোখের অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়,তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যান। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কো পাঠায়, মস্কো থাকাকালীন সময়ে হাসপাতালে বসেই ১৬ই ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ পান। সেখানকার বাঙ্গালীদের মুক্তির উল্লাস প্রত্যক্ষ করেন, তিনি নিজেও অশ্রুসিক্ত নয়নে ওই আনন্দ উপভোগ করেন। ১৯৭২সালে মুক্ত-স্বাধীন স্বপ্নের স্বদেশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পাকিস্তান পর্যায়ে তিনি ১৪ বছর কারাভোগ করেন, ১৯৬৮ সালে কারা থেকে মুক্তি পান। এ বছরের শেষের দিকে সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মোস্তফা ওয়াহিদ খান, কামরুল অাহসান খান,মঞ্জুরুল আহসান খান সহ এক ঝাঁক প্রগতিশীল তরুণ উদীচী গঠন করেন। প্রথম হলো আহ্বায়ক কমিটি -এতে আহ্বায়ক হলেন কামরুল আহসান খান আর সবাই সদস্য হলেন।
লেখক- ডাঃসুনীল কুমার বিশ্বাস, রাজবাড়ী।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়