ছোটগল্প “অভিযান” – লেখকঃ শিপন আলম –

- Update Time : ০৮:২৭:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ মে ২০২১
- / ২৪ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
দিবসের সবটুকু রৌদ্র কোথায় যেন দ্রুতই মিলিয়ে গিয়ে পশ্চিমাকাশের পাহাড় সদৃশ এলোমেলো মেঘগুলো সিথির সিঁদুরের ন্যায় লালচে বর্ণ ধারণ করলো। শরতের বিকেল আর কচু পাতায় পতিত পানির স্থায়িত্ব যেন একই। দুটোই মানব হৃদয়ে সৌন্দর্যের ছটা ছিটিয়ে, মনকে আন্দোলিত করে খুব দ্রুত হারিয়ে যায়।
সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঝি তার নৌকার ইঞ্জিন স্টার্ট দিবে। ধীরে ধীরে সবাই নৌকার দিকে আসতে শুরু করলো। মাঝিও সবাইকে নৌকায় এসে বসার জন্য হাঁক-ডাক ছাড়তে লাগলো। মাঝির হাঁক-ডাক আর নৌকায় আগত যাত্রীদের উপস্থিতি যতই বাড়তে লাগলো সিয়ামের মনে অস্থিরতার পারদ ততই বেড়ে চললো। ছেলে দুটো আর মেয়েটিকে নিয়ে কিশোর বয়সী ছেলেগুলো তখন অনেক দূরে মিলিয়ে গিয়েছে। তাদের আর কোন নিশানা চোখে পড়ছে না। উঠতি বয়সের তরুণ সবাই। আবেগ আর উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তাহলে এই দশ-বারোটি ছেলে-মেয়ের জীবনেই ঘোর অমানিশার নিকষ অন্ধকার নেমে আসবে। সাথে হারিয়ে যাবে তাদেরকে ঘিরে পরিবারের স্বপ্নগুলোও। শুনেছি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এরকম উঠতি বয়সের তরুণেরা বিভিন্ন গ্যাং তৈরি করে ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তার প্রভাব যদি এখন গ্রাম পর্যায়ে এসেও পড়ে তাহলে তো এ জাতির ভবিষ্যৎ বড়ই বেদনাদায়ক।
সিয়াম এসব ভাবতে ভাবতেই নৌকা ছাড়ার উপক্রম হলো। সাথে আসা সহকর্মী নাজির ভাইকে সে বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
- এখন কি করা যায় নাজির ভাই?
নাজির ভাই বয়সে সিয়ামের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় হলেও তারা একই সাথে চাকরিতে যোগদান করেছে। দুজনেই একটি প্রতিষ্ঠানের নবীন কর্মকর্তা। চাকরি ও চাকরির বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক যোগাযোগ দু’জনের এই বয়সের ব্যবধানকে কমিয়ে নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত করেছে। আজকের মতো বিকেল হলেই একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হওয়া তাদের নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘুরাঘুরি শেষে আরও অনেকের সাথে চায়ের স্টলে বসে চা খাওয়া, মিষ্টির দোকানে বসে আয়েস করে টক দই খাওয়া, রাজনীতি, অরাজনীতি, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ করা তাদের নিত্য কর্মের মধ্যেই পড়ে। নাজির ভাই বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী তবে কম উদ্যোগী; তিনি সাহসী তবে ঝুঁকি এড়িয়ে চলেন; আত্মসচেতন তবে আত্মকেন্দ্রিক নন; পরদুঃখকাতর তবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নয়। অপরদিকে সিয়ামের স্বভাব পুরোপুরি বিপরীত। সে উদ্যোগী, কৌতুহলী, পরদুঃখকাতর এবং একই সাথে ঝুঁকিপ্রিয়। তবে দু’জনের মধ্যে একটি সাধারণ গুণ আছে- কেউই স্বার্থপর নয়। একজন কোন ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে অন্যজন ভাল না লাগলেও তাতে সায় দেয়। তাই সিয়াম যখন বিচলিতভাবে জিজ্ঞেস করলো কি করা যায় তখন নাজির ভাইও তাতে সায় দিয়ে বললেন
-কিছু একটা করা দরকার।
কিন্তু কি করা যায় সে ব্যাপারে কিছু বললেন না।
নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবে আর কোন কথা না বাড়িয়ে নৌকা থেকে নামতে যাবে এমন সময় সিয়াম দেখতে পেলো তাদের থেকে বেশ দূরে চরটি যেখানে নিচু হতে হতে আবার উঁচু হয়েছে তার চূড়ায় দু-তিনজন তরুণ তাদের দিকে হাত ইশারা করছে। হাত ইশারার উদ্দেশ্য কি তা বুঝতে কষ্ট হলো না সিয়ামের। নৌকা ছাড়ার উপক্রম হওয়ায় হাত ইশারা করে তারা না আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে বলছে।
- একটু পরে রওনা দেন, ঐ যে কয়টা ছেলে আসছে।
সিয়াম মাঝিকে বললো। কিন্তু যাত্রীদের হট্টগোল, ইঞ্জিনের শব্দ আর খোলা নদীতে বাতাসের শনশন শব্দে মাঝি তার দিকে তাকালেন বটে তবে কিছুই শুনতে পেলেন না। তখন হাত দিয়ে চরের মধ্যে হঠাৎ আগত
ছেলেদের দিকে ইঙ্গিত করলেন। মাঝিকে ইশারায় দেখাতে গিয়ে সে খেয়াল করলো আরও কয়েকজন ছেলে নিচু খাল পেরিয়ে উপরে উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যাটা ছয় সাত জনের মতো হলো।
নৌকার নিকটবর্তী হতেই সিয়াম তাদের জিজ্ঞাসা করলো - তোমরা কি কয়েকজন ছেলে আর একটা মেয়েকে তোমাদের দিকটা দিয়ে যেতে দেখেছ?
- হ্যাঁ, যেতে দেখেছি, তবে ওরা আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দূর দিয়ে চরের ভেতরের দিকে চলে গেছে। ওদের কথার আওয়াজ শুনে মনে হলো কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।
আগত ছেলেদের মধ্যে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা একটি ছেলে উত্তর দিলো। সিয়াম খেয়াল করে দেখলো ওরা সংখ্যায় মোট সাত জন। ওদের মধ্যে চশমা পরা এই ছেলেটি বাদে বাকি কারো চোখে চশমা নেই। তবে কয়েকজনের চোখে সানগ্লাস ছিলো। ওদেরকে দেখে খুবই উদ্যমী ও সাহসী মনে হলো। নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পর সিয়াম জানতে পারলো ওরা জেলার টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র।
- আমি যদি বলি আমরা মেয়েসহ ছেলে দুটোকে খুঁজতে যাব তোমরা কি যাবে আমাদের সাথে? সিয়াম ঠোঁটের কোণে খানিকটা সংকোচ নিয়ে তাদের মনোভাব জানার জন্য জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু সীমাহীন উদ্যম আর সাহসিকতায় ভরা এই সাতজন তরুণই তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সমস্বরে বলে উঠল
- হ্যাঁ, অবশ্যই।
- তাহলে নেমে পড়ুন, নাজির ভাই।
তবে সিয়াম বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করলো নৌকার আর কোন যাত্রী এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না। সিয়াম মাঝি ও যাত্রীদের বললো আপনারা ঘাটে গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা জানিয়ে আরেকটি নৌকা পাঠাতে বলবেন। মাঝি ‘জি’ বলে ইঞ্জিনের প্যাডেল সজোরে বার কয়েক ঘুরাতেই মেশিনের চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া উদগীরণ করে সন্ধ্যার নির্জনতাকে ভঙ্গ করে নৌকা সবেগে ঘাটের দিকে ধাবিত হলো।
সন্ধ্যা গড়িয়ে ধীরে ধীরে নির্জন চরের বুকে রাত নেমে এলো। বাতাসের একটানা শনশন আওয়াজ, চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকাসহ নানা রকম পোকার ঝিঁ ঝিঁ, কটর মটর, চিঁ চিঁ শব্দ আর দূরের বন থেকে ভেসে আসা খেক শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক চরের এই নির্জনতাকে এক ভয়ানক রূপ দান করলো। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে বসন্তের সেই সুনসান রাতে সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের বুকে ঝুলে থাকা আধখানা চাঁদের মায়াবী আলো চরের সাদা বালির উপর পতিত হয়ে রাতের অন্ধকারকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছিল। উপরন্তু সবার হাতেই ছিল মোবাইলের টর্চলাইট। - আমরা যেহেতু একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাচ্ছি আমাদের অবশ্যই কিছু পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। সিয়াম চৌদ্দটি উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।
- আর পরিকল্পনাটি অবশ্যই নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন। বড় কোন ঝুঁকিতে পড়া যাবে না। নাজির ভাই যোগ করলেন।
- ঠিক তাই। সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে। কোন ভাবেই বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। মোবাইলের টর্চ লাইট অফ করে চুপি চুপি এগোতে হবে যাতে ওরা আমাদের দূর থেকে দেখতে না পায়। আর ওদের কাছাকাছি যেতেই সবাই একসাথে ‘ধর’ বলে জোরে জোরে চিৎকার করতে হবে যাতে ওরা আমাদের সংখ্যাটিকে অনেক বেশি মনে করে ভয়ে দূরে পালিয়ে যায়।’
নিস্তব্ধ রাতের আধো আঁধারকে দূরে ঠেলে মাথার ওপর ঝুলে থাকা আধখানা চাঁদের জোছনায় সিয়ামের নির্দেশনামতো সবাই একসাথে পথচলা শুরু করলো। কেডস, সু আর চটি স্যান্ডেল পরিহিত আঠারোখানা পা-কে শুকনো মাটি আর বালি যেন পরম আতিথ্যে জায়গা করে দিচ্ছিলো। নরম বালিতে অল্প গেড়ে যাওয়া পায়ের সম্মুখ অংশের আঘাতে বালিরাশি অল্প দূরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিলো। উঁচু নিচু পথ মাড়িয়ে তারা সম্মুখে ধাবিত হতে লাগলো। সদ্য শুকানো ছোট ছোট খালের কিনারা দিয়ে যখন তারা যাচ্ছিলো বালির উপর থাকা চাকার মতো দেখতে শুকনো খড়খড়ে মাটি কড়মড় করে ভেঙে আশ্চর্য এক সঙ্গীত দ্যোতনা সৃষ্টি করছিলো। নদীর সাথে মিতালি করে বেড়ে ওঠা সিয়ামের নিকট এ শব্দ খুবই পরিচিত। একটি খালের উপর দিয়ে অতিক্রমকালে খালের পাড়ে বেড়ে ওঠা একটি ঝোঁপ থেকে হঠাৎই ফুরুৎ করে একটি ছোট পাখি শব্দ করতে করতে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে উড়ে পালালো। বোধ হয় বাটই পাখি হবে। ছাত্রদের মধ্যে দু’একজন মনে হলো কিঞ্চিৎ ভয় পেয়েছে। সিয়ামের মনে পড়ে গেল ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে এসব পাখির বাসা আর ডিম খুঁজে খুঁজে ।
নিঃশব্দে উঁচু নিচু ঢালু পথ পাড়ি দিতে দিতে তারা প্রায় বড় খালটির নিকট চলে এলো। কেউ একজন বললো দূরে খালের পাড়ে মানুষের মতো কয়েকটা ছায়া সদৃশ কিছু দেখা যাচ্ছে। সিয়াম একটু উঁচু জায়গায় উঠে টি-শার্টের উপর দিয়ে বুকের ওপর ঝুলে থাকা পাওয়ারওয়ালা শক্ত ফ্রেমের চশমাটি চোখে দিয়ে আবছা অন্ধকারকে ভেদ করে ছায়ামূর্তিগুলো দেখার চেষ্টা করলো। নতুন চাঁদের নতুন জোছনায় সিয়াম গুনে গুনে একে একে চারটি ছায়ামূর্তি আবিষ্কার করলো। কিশোর ছেলেগুলোকে ভরকে দেওয়ার এখনই সময় যাতে ওরা আমাদের সংখ্যা সম্পর্কে কোন ধারণা করতে না পারে। ভাবা মাত্রই সিয়ামের মুখ থেকে বিকট জোরে ‘ধর’ শব্দটি বেরিয়ে আসতেই বাকি আটজনও একযোগে ‘ধর’ বলে প্রচণ্ড এক বজ্র নিনাদের সৃষ্টি করে বালির স্তূপ অতিক্রম করে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সামনের দিকে ধাবিত হলো। হঠাৎই সিয়ামের মাথায় আরেকটি বুদ্ধি খেলে গেল। রাতের পরিবেশ এমন যে প্রকৃত অবস্থা বোধগম্য হয় না। যুগে যুগে অনেক দূর্বল প্রতিপক্ষ অন্ধকারের এই নির্জনতাকে কাজে লাগিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে প্রকৃত অবস্থা বুঝতে না দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে জয়লাভ করেছে। ইউটিউব এর ভিডিয়োতে, গুগল এর পেজে আর বইয়ের পৃষ্ঠায় এসব বিপজ্জনক অভিযানের দুর্র্ধষ কাহিনি সযতেœ লেখা আছে। একজন অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসেবে সিয়ামের এসব অভিযানের কথা অজানা নয়। সে ভাবলো আরেকটি কৌশল নিলে কেমন হয়। আমরা কারা তা তো আর ঐ ছেলেগুলো জানে না। আমাদের সাথে কি অস্ত্র আছে তাও তারা জানে না। আমরা সংখ্যায় কতজন সেটিও তাদের জানার কথা নয়।
এখন আমরা যদি গুলির কথা বলি তাহলে তা তাদের জন্য ভয়ের কারণ হবে। ভাবামাত্রই সে চিৎকার করে বলে উঠলো
- এই…, গুলি করার দরকার নেই। ছেড়ে দে, গুলি করার দরকার নেই।
কথাটি সে দ্রুত বলতে বলতে সামনের দিকে ছুটে চললো। পাশে থাকা নাজির ভাই তো এই কথায় একটু হো হো করে হেসেই ফেললেন। এটি যে একটি কৌশল তা তিনিও বুঝতে পারলেন। সিয়াম আর নাজির ভাই পাশাপাশি দৌড়াচ্ছিলো। সামনে আর আশেপাশে ছিল ছেলেরা। তাদের কয়েকজন দ্রুত দৌড়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিলো। বড় খালটার পাড়ে বালি অনেকটা শক্ত হয়েছিলো। পাড় থেকে ঢালু জায়গায় যেতেই সিয়ামের কানে এলো - ভাই, আমাদের ছেলে-মেয়েদের পাওয়া গেছে। দৌড়ে গিয়ে সিয়াম দেখলো একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে তাদের ছেলেরা ঘিরে রেখেছে।
- আমি তো বিকেলে তিনজনকে দেখেছি, আরেকটি ছেলে কোথায়?
(সংক্ষেপিত)
লেখকঃ শিপন আলম
প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়