রাজবাড়ী জেলার সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত: শিপন আলম –
- Update Time : ০৫:৫৮:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ অগাস্ট ২০২০
- / ২০ Time View
সারা পৃথিবীর প্রাণ জুড়ায় প্রকৃতির আদরের দুলালী ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আমাদের এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গাঙ্গেয় বদ্বীপ। সেই হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা থেকে শুরু করে আজকের পর্যটক পর্যন্ত সবাই বাংলার অপরূপ রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছে। বাংলার এই মনোমুগ্ধকর রূপ সৌন্দর্যই আবহমানকাল থেকে ধারণ করে আসছে আমাদের এই ছোট্ট জেলা রাজবাড়ী। দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ, পাখ-পাখালির কিচির মিচির, শীতের সকালের মিষ্টি রোদ, বর্ষার টাপুর টুপুর বৃষ্টি, জোছনামাখা তারা ভরা আকাশ, ঝিরিঝিরি বাতাস- প্রকৃতির সব উপাদান মিলে রাজবাড়ী যেন পুরো বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। তাই সীমাহীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী রাজবাড়ী জেলার পর্যটন সামান্য একটু পরিচর্যায়ই হতে পারে বিপুল সম্ভাবনাময়, আকৃষ্ট করতে পারে দেশি বিদেশি পর্যটককে।
পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যাদের অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। মালদ্বীপের জাতীয় অর্থনীতির অধিকাংশ ও মালয়েশিয়ার জিডিপির ৭ শতাংশ পর্যটনশিল্পের অবদান। আমাদের দেশেরও অনেক জেলা বিশেষ করে কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবন, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলা পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম জায়গা। বর্তমানে দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এ খাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ। অথচ পর্যটনের সম্ভাবনাময় অনেক উৎস থাকার পরেও প্রচার প্রচারণা, উপস্থাপনা ও যথোপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে আমরা রাজবাড়ীর উন্নয়নের জন্য অফুরন্ত সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে কাজে লাগাতে পারছি না।
স্রষ্টা দ্বারা সৃষ্ট যেসকল সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে বার বার তার সান্নিধ্যে টেনে নিয়ে যায় সেগুলোর মধ্যে সমুদ্র আর নদী অন্যতম। আমাদের সমুদ্র না থাকলেও আছে সমুদ্রের মতোই বিপুল ঐশ্বর্যময় বিশাল পদ্মা নদী। রাজবাড়ী জেলার পর্যটনের মূল আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার রাজবাড়ীবাসীর ভাল লাগা ও ভালবাসার জায়গা তাই এই খরস্রোতা পদ্মা নদী। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলার প্রবেশদ্বার এই পদ্মানদী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বিপুল অবদান রেখে চলেছে। পদ্মা ও যমুনার মিলনস্থল রাজবাড়ী জেলা তাই অন্য জেলাগুলো থেকে স্বতন্ত্র। বিপুল সম্ভাবনাময় আর বৈচিত্র্েয ভরা এই পদ্মাকে কেন্দ্র করে তাই তীরবর্তী গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট পর্যটন স্পট । এসবের মধ্যে গোয়ালন্দ ঘাট, গোদারবাজার পদ্মার পাড়, হাবাসপুর পদ্মার ঘাট, বাহাদুরপুর পদ্মার পাড় উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে পদ্মার বুকে জেগে ওঠা ছোট বড় চর সৌন্দর্য প্রিয় মানুষদের নিকট খুবই আকাঙ্ক্ষিত জায়গা। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ যেমন ছয় ঋতুতে ছয়রকম রূপ ধারণ করে তেমনি পদ্মা নদীও ষড়ঋতুর প্রভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কখনো তার বুক জুড়ে তীব্র স্রোতের আনাগোনা, প্লাবিত করে মাইলের পর মাইল, ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও। কখনো তার তাণ্ডবে শুরু হয় প্রবল ভাঙ্গন, উজাড় হয় ফসলি জমি, বসত ভিটা, মসজিদ মন্দির, স্কুল কলেজ সহ মূল্যবান স্থাপনা। মানুষ হয়ে পড়ে বড়ই অসহায়। কখনো তার বুকজুড়ে উঁকি দেয় দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ, কাশফুলের নরম ছোয়ায় শিহরিত করে তোলে সবাইকে। কখনো বা তার বুক জুড়ে বিরাজ করে পিন পতন নীরবতা। কখনো বা ধূ ধূ বালিকারাশি। কখনো বা পাখির কিচির মিচির আর গবাদী পশুর বিচরণ। গরমের রাতে পদ্মার বুকে ভেসে থাকা ডিঙি নৌকার উপর শুয়ে মৃদু বাতাসে তারা ভরা আকাশে রূপালি জোছনার পাগল করা সৌন্দর্য যে একবার অবলোকন করেছে সে আর কোনদিন ভুলতে পারবে না। বিপুল সৌন্দর্যের আধার এই পদ্মাকে যদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো যায় তবে তা হয়ে উঠতে পারে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। পদ্মাকে তাই কাঙ্ক্ষিত মানের পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে প্রয়োজন এর ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গোয়ালন্দ থেকে রাজবাড়ী, কালুখালী হয়ে হাবাসপুর, বাহাদুরপুর পর্যন্ত টুরিস্ট রোড গড়ে তুলতে পারলে তা রাজবাড়ীর পর্যটনে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ করলে ও পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে সবুজায়ন করলে তা সৌন্দর্য পিপাসু মানুষদের আরও বেশি আকৃষ্ট করবে। সারা বছর যাতে দর্শনার্থীরা এখানে আসতে পারে তার জন্য কিছু স্থায়ী পিকনিক স্পটের ব্যবস্থা করলে এবং ঋতু ভেদে প্রয়োজন সাপেক্ষে কিছু অস্থায়ী পিকনিক স্পটের ব্যবস্থাও পর্যটকদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
পদ্মার তীর, চর এবং পদ্মায় নৌ বিহার এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেয়। বর্ষার প্রমত্তা পদ্মা, জেলেদের মাছ শিকার, রাতের নদীতে মাছ ধরার নৌকায় মিটিমিটি জ্বলা বাতি, পূর্নিমা রাতের রূপালী পদ্মা, শরতের কাশফলে ঢাকা পদ্মার চর, আর শীত থেকে গ্রীষ্ম ঋতুতে পদ্মার চরে ভ্রমন, পিকনিক, শ্যুটিং আর নদীর স্বচ্ছ পানিতে লাফালাফি ঝাপাঝাপির এক মুখরিত সুযোগ এনে দেয় পদ্মা নদী। পদ্মাই রাজবাড়ীর বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট। জেলা ব্র্যান্ডিং এর ক্ষেত্রেও তাই পদ্মাকেই হাইলাইট করা হয়েছে। রাজবাড়ী জেলার জেলা ব্র্যান্ডিং এর শ্লোগান হচ্ছে – “পদ্মা কন্যা রাজবাড়ী
তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।”
পদ্মা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি নদী যেমন চন্দনা, গড়াই, হরাই, চত্রাই, কুমার রাজবাড়ীর ভেতর দিয়ে আঁকাবাকা জালের মত বয়ে চলেছে যেগুলো আপন সৌন্দর্যে বিকশিত। এসকল নদীকে যথাযথভাবে শাসনের মাধ্যমে নাব্যতা ও সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারলে এগুলোই হতে পারে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণস্থল।
একটি অঞ্চলের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে সে অঞ্চলের মাটিতে জন্ম নেওয়া কীর্তিমান সন্তানদের বেড়ে ওঠার স্থান, ব্যবহার্য সামগ্রী, রেখে যাওয়া নানা স্মৃতি যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার জন্য পাথেয়। রাজবাড়ী জেলাও এ রকম ক্ষণজন্মা কিছু সন্তানের জন্য গর্বিত যারা শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন, জ্ঞান সাধনা ও বিজ্ঞান সাধনায় দেশে ও বিদেশে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এসকল মহান সন্তানদের মধ্যে বিষাদ-সিন্ধু খ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, পাকিস্তানের প্রথম স্পীকার ও আয়ুব সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তমিজউদদীন খাঁন, মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথিকৃৎ সাহিত্যিক কাজী আব্দুল ওদুদ, জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন, সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী,’মাসুদ রানা’ সিরিজ লেখক- কাজী আনোয়ার হোসেন,স্বনামধন্য সাবেক আমলা ও সাবেক সফল প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা, অঙ্কন শিল্পী রাশিদ চৌধুরী ও মনসুর-উল-করিম, প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও রবীন্দ্র গবেষক ড. সানজিদা খাতুন, ছড়াকার রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, স্বনামধন্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রোজিনা ও বর্তমান সময়ের সাড়া জাগানো নায়িকা শাবনূর, বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম অস্কার বিজয়ী তরুণ বিজ্ঞানী নাফিজ বিন জাফরসহ অসংখ্য খ্যাতিমান সন্তানের জন্ম দিয়েছে রাজবাড়ীর উর্বর মৃত্তিকা। এসব ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিচিহ্ন গুলো যদি যথাযথ মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করা যায় তবে তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঐতিহাসিক, শিল্প ও সাহিত্যানুরাগীসহ সব ধরনের পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারে।
পর্যটকদের নিকট বিভিন্ন সময়ের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আরেকটি আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। কুমিল্লার ময়নামতি বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের ন্যায় জাতীয় কোন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন রাজবাড়ীতে না থাকলেও জেলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মূল্যবান প্রতœতত্ত্ব যা সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এগুলোই হয়ে উঠতে পারে দর্শনার্থীদের নিকট জ্ঞান আহরণের মূল্যবান উপকরণ। রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের লাল ভবন, নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির, সমাধিনগর মঠ, নীলকুঠি, পাচুড়িয়া জমিদার বাড়ি, টাকার মাইট, বানিবহে পুস্কুলাগা, পাংশায় মালু ভাগ্যবানের পুকুর, চাঁদ সওদাগরের ঢিবি, সেকারায় শাহ পালোয়ানের পূর্ব পশ্চিম মাজার, জামাই পাগলের মাজার, হযরত শাহ জুঁই (রাঃ)- এর মাজার, রথখোলা সানমঞ্চ প্রভৃতিসহ এ জেলায় প্রাচীন আমলের বহু ঐতিহাসিক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিদ্যমান। এসব প্রাচীণ নিদর্শনসমূহ একদিকে যেমন পর্যটকদের মনের খোরাক যোগাচ্ছে অন্যদিকে তেমনি রাজবাড়ীর পর্যটন খাতকেও করেছে সমৃদ্ধ।
রাজবাড়ীর পর্যটন খাত বিকাশের জন্য পদ্মার ওপর দিয়ে দৌলতদিয়া- পাটুরিয়া সেতু বা দ্বিতীয় পদ্মা সেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথম পদ্মাসেতুর কাজ ইতোমধ্যে প্রায় ৮১ শতাংশ সম্পন্ন হওয়ায় সরকার এখন দ্বিতীয় পদ্মাসেতু নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। ৬.১০ কি.মি. দৈর্ঘবিশিষ্ট এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ প্রকল্পের প্রস্তাব ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সাথে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হবে। জেলায় অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও গতিশীলতা আসবে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের ভ্রমণ ব্যয়ের পাশাপাশি সময়ও সাশ্রয় হবে। রাজবাড়ীর রেলপথকে সম্প্রসারিত করে ঢাকার সাথে সংযুক্ত করা হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। পদ্মার সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে যদি বিশ্বমানের দৃষ্টিনন্দন স্টেডিয়াম করা যায় তবে তা রাজবাড়ী জেলার পর্যটন খাতকে ঈর্ষনীয় সাফল্য এনে দিতে পারে। তাছাড়া এ সেতুকে কেন্দ্র করে ইকো টুরিজম গড়ে তোলা সম্ভব হলে তা রাজবাড়ীর পর্যটনকে আরও বেশি চাঙা করে তুলবে।
রাজবাড়ীর পর্যটন খাতের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় প্রকল্প হচ্ছে পদ্মা ব্যারেজ। রাজবাড়ী ছাড়াও এ ব্যারেজের সরাসরি সুফল ভোগ করত দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা ও সেখানকার মানুষ। কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা বজায় রাখা ও হারানো নৌপথ উদ্ধারের জন্য এ প্রকল্পটি হচ্ছে মাইলফলকস্বরূপ। কিন্তু হঠাৎই প্রকল্পের স্থান ও জরিপে ত্রুটির অভিযোগে প্রকল্পটির কাজ স্থগিত হয়ে যায়। প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এখন চেষ্টা চলছে বিদ্যমান ত্রুটিগুলো দূর করে ভারতের সাথে যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা। রাজবাড়ীতে এটি বাস্তবায়ন হলে রাজবাড়ী বিশেষত পাংশা উপজেলার পর্যটনসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হবে।
ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের যাতায়াতের সবচেয়ে আরামদায়ক মাধ্যম হচ্ছে রেলপথ। সুখের বিষয় রাজবাড়ী জেলা ঐতিহ্যগতভাবেই রেলের শহর নামে পরিচিত। ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারিতে রাজবাড়ীতে রেলসংযোগের পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুটে রেল সংযোগ স্থাপিত হলেও রাজবাড়ী রেলওেয়ের জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ আসে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। সেদিন বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রাজবাড়ীতে দক্ষিণাঞ্চলীয় রেলওেয়ের বিভাগীয় কার্যালয় ও কারখানা স্থাপনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চল মিলে রেলওয়ের দক্ষিণাঞ্চল গঠিত যার সদর দপ্তর হবে ফরিদপুরে। রাজবাড়ী থেকে দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু করা হবে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে রাজবাড়ীতে এক ধরণের বিপ্লব সাধিত হবে। দেশীয় দর্শনার্থীর পাশাপাশি ভারতের সাথে এ রেলপথের যোগাযোগ থাকায় বিদেশী দর্শনার্থীরাও রাজবাড়ীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসতে পারবে।
রাজবাড়ীর পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও এ খাতের প্রত্যাশিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রত্যেক জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি হিসেবে রাজবাড়ীতে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে। এতে করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগমণের পদচারণায় মুখরিত হবে রাজবাড়ী। উন্মোচিত হবে পর্যটনের নতুন নতুন সম্ভাবনা।
পর্যটন খাতের বিকাশের জন্য প্রয়োজন বৈচিত্রধর্মী খাবার। সংখ্যায় কম হলেও রাজবাড়ী জেলায় বেশ কিছু খাদ্যসামগ্রী আছে যার খ্যাতি পুরো দেশব্যাপী যা ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারে। রাজবাড়ী জেলার উল্লেখযোগ্য খাদ্যপণ্যের মধ্যে চমচম বিশেষ ভাবে পরিচিত। জেলার নামকরা মিষ্টির দোকান ‘শংকর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’, ‘নির্ম্মল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’, ‘মিষ্টিবাড়ী’ থেকে চমচম দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। তাছাড়া পাংশার ভবেশের দই, শশাঙ্ক চানাচুর প্রভৃতিও যথেষ্ট নামকরা। এগুলো ছাড়াও খেজুরের রস এবং তা থেকে তৈরি গুড়ও বেশ জনপ্রিয়। চাউলের রুটির সাথে মুরগীর গোস্ত, সেই সাথে চিতই পিঠা, ধুপি পিঠা, কুশলীপিঠাও সবার নিকট প্রিয়। তাছাড়া রাজবাড়ীর রূপালি ইলিশ, কৈ মাছ, মাগুর মাছ, শোল মাছ, বোয়াল মাছ এসব গ্রামীণ খাবার ভ্রমণ পিপাসুদের রাজবাড়ীতে টেনে আনার জন্য যথেষ্ট।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকেও রাজবাড়ী জেলার পর্যটন যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। রাজবাড়ী সদ্য ঘোষিত ফরিদপুর বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। এটি দেশের প্রায় একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে এর দূরত্ব মাত্র ১১৮ কি.মি.। এটি রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলার প্রবেশদ্বার । সড়কপথের পাশাপাশি এখানকার রেলপথ গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথেও রয়েছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সহজেই মানুষ এখানে বেড়াতে আসতে পারে। সড়কপথ, রেলপথ ও নৌপথ- যোগাযোগের এ তিন মাধ্যম ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য এক রোমাঞ্চকর বিচিত্র অভিজ্ঞতা এনে দিতে পারে।
পর্যাপ্ত আবাসনের সুব্যবস্থা থাকা একটি জেলার পর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আশার কথা হলো রাজবাড়ী জেলায় আগত পর্যটকদের জন্য আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে জেলায় বছরে আনুমানিক ২৫,০০০ পর্যটকের আগমন ঘটে। এ সকল পর্যটকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি মালিকানায় একাধিক রেস্ট হাইস ও আবাসিক হোটেল রয়েছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-রাজবাড়ী সার্কিট হাউস, পাংশা ডাকবাংলো, গোয়ালন্দ ডাকবাংলো, বালিয়াকান্দি ডাকবাংলো, হোটেল পার্ক, গুলশান বোর্ডিং, প্রাইম হোটেল, মিড টাউন হোটেল, হোটেল লতিফ, নিরালা হোটেল । এ সমস্ত রেস্ট হাউসে ও হোটেলে থাকা ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। নদী ভ্রমণের জন্য নৌকা ও স্পিড বোট পাওয়া যায়। সম্প্রতি রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া মহাসড়ককে ডাবল লেন থেকে ফোর লেনে উন্নীতকরণের কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ায় সড়ক পথে যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ ভালো ও সহজলভ্য হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বিপুল ঐশ্বর্যময় বিশাল পদ্মার অপার সৌন্দর্য, দিগন্ত বিস্তৃত শাশ্বত সবুজের সরব উপস্থিতি, আবহমান বাংলার সরল মানুষের সহজ জীবন যাপন, বিখ্যাত সব মনীষীদের স্মৃতিধন্য পদচারণা, মূল্যবান প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদের সম্ভার, গ্রামীণ মুখরোচক ও সুস্বাদু সব খাবার, সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান, তুলনামূলক কম দু্র্েভাগপ্রবণতা, সহজ ও উন্নত যোগাযোগ মাধ্যম প্রভৃতি রাজবাড়ী জেলার পর্যটন বিকাশে সম্ভাবনার নতুন নতুন দুয়ার উন্মোচন করে চলেছে। তবে প্রত্যাশিত অবকাঠামো উন্নয়ন, রাজনৈতিক উদ্যোগ, প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বিনোদন বিকাশের সুযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পর্যটন এলাকায় হোটেল বৃদ্ধি এবং পর্যটন ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারলে, নবদিগন্তের ভোরের সূর্যের আলোর ন্যায় আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনার রাজবাড়ীর পর্যটন।
লেখক- শিপন আলম
প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়