আমাদের ‘কাজী-দা’: শিপন আলম –
- Update Time : ০৭:১০:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ জুলাই ২০২০
- / ২১ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
‘প্রচণ্ড শীত। মাঘের প্রথম। রাত দেড়টা। সেগুন বাগান। সমস্ত এলাকাটা ঘুমে অচেতন। জন প্রাণির সাড়া শব্দ নেই। কেবল টহলদার নাইট গার্ড টহল দিয়ে ফিরছে। মাঝে মাঝে হুইসেল বাজাচ্ছে, সাথে সাথেই ক্ষীণ প্রত্যুত্তর আসছে ভেসে।’…..
শীতের জরাজীর্ণতার মতো গতানুগতিক সাহিত্যকর্মের ভারে ন্যুব্জ আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে টহলদার নাইট গার্ডের ন্যায় হুইসল বাজিয়ে যিনি নতুন ধারা দেখিয়ে কোটি কোটি পাঠককে সাহিত্যের রস আস্বাদনে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন তিনি বাংলাদেশের রোমাঞ্চকর থ্রিলিংধর্মী গল্প উপন্যাসের পথিকৃৎ কাজী আনোয়ার হোসেন। ষাটের দশকে কুয়াশা সিরিজের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য পাঠককে সেই যে তিনি থ্রিলিং জগতে প্রবেশ করালেন, মাসুদ রানা’র মাধ্যমে সেই যে জাদুকরের ন্যায় মন্ত্র মুগ্ধে আবদ্ধ করলেন তার রেশ থেকে এখনো পাঠকসমাজ বেরিয়ে যেতে পারে নি। এখনো থ্রিলিং উপন্যাস বলতে যে নামটি সর্বাগ্রে মানসপটে ভেসে ওঠে সেটি হল মাসুদ রানা।
স্রোতের বিপরীতে হাঁটা অদম্য অধ্যবসায়ী এবং আত্ম-বিশ্লেষণকারী এই মানুষটির জন্ম ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই ঢাকায়। রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়ি। তাঁর পিতা ড.কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা অধ্যাপক, লেখক, বিজ্ঞানী, দাবাড়ু, সঙ্গীতজ্ঞ, ভাষা সৈনিক প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি। তাঁর মায়ের নাম সাজেদা বেগম যিনি সুশিক্ষিতা, সাহিত্যমনা, মার্জিত ও রুচিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’ ও ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাস দুটি উর্দুতে অনুবাদ করেন।
কাজী আনোয়ার হোসেনের পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। তবে তিনি ‘নবাব’ ডাকনামেই সবার নিকট পরিচিত ছিলেন। আর পাঠকদের নিকট তিনি পরিচিত প্রিয় ‘কাজী-দা’ নামে। ৭ ভাই ও ৪ বোন মিলিয়ে একটি বৃহৎ পরিবারে জন্ম তার। পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষক থাকায় নিজ বাসা সেগুনবাগিচায় স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বে তার শৈশব ও কৈশোরের সোনালি দিনগুলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতেই কেটেছে।
তিনি ১৯৫২ সনে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমানে এসএসসি) পাশ করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ (বর্তমানে এইচএসসি) ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করে তিনি বেতারে নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়মমাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না থাকলেও বাবা ও মায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কাজী বাড়িতে নিয়মিতই সঙ্গীত চর্চা হতো। তাঁর তিন বোন ড. সনজীদা খাতুন,ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন বাংলাদেশের খ্যাতনামা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সন পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। বেতারে গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি সিনেমায় প্লে-ব্যাকও করতে থাকেন। তিনি ১৯৬২ সনে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের বোন খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কাজীদা ও ফরিদা দম্পতির রয়েছে দুই পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তান যারা বর্তমানে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আপন গুণে প্রতিষ্ঠিত।
কৈশোর থেকেই তিনি থ্রিলিং প্রিয়। রহস্যে ঘেরা অদ্ভুত দুনিয়ায় যার অবাধ বিচরণ। তাই রেডিও-টিভিতে গান গাওয়া কিংবা সিনেমার প্লে-ব্যাকে তিনি বেশি দিন মনোযোগ রাখতে পারেন নি। ১৯৬৩ সনে তাই বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় ‘সেগুনবাগান প্রেস’ নামে একটি প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। তবে পরে এই ‘সেগুন বাগান প্রেস’- এর ‘সেগুন’ ও ‘বাগান’ শব্দ দুটির আদ্যক্ষর নিয়ে নাম পাল্টে হয় বর্তমানের জনপ্রিয় পাঠকনন্দিত সেবা প্রকাশনী।
প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই সেবা প্রকাশনী পাঠক সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ প্রকাশনার প্রথম পাঠকনন্দিত সিরিজের নাম কুয়াশা। কবিতা, উপন্যাস ও নাটকের গতানুগতিক ধারায় পাঠক সমাজ যখন সাহিত্যের মধ্যে নতুন কিছু অন্বেষণ করছিল তখনই আবির্ভাব হয় এ সিরিজটি। ব্যাপক পাঠকপ্রিয় আর বিপুল চাহিদার কারণে এ সিরিজের একটানা ১৪ টি বই লেখার পর তিনি ‘গোস্ট রাইটারের’ সহযোগিতা নেন। এ সিরিজের মোট ৭৮টি বই প্রকাশ পেয়েছে যা পরে ২৫টি ভলিউমে পুনঃপ্রকাশিত হয়। কুয়াশা সিরিজের জনপ্রিয়তার মাঝেই তিনি বাঙালি পাঠক সমাজকে পরিচয় করিয়ে দেন তার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্বাধিক প্রকাশিত গুপ্তচর কাহিনী সিরিজ ‘মাসুদ রানা’। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘ধ্বংস পাহাড়’ দিয়ে যাত্রা শুরু এ সিরিজটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মাসুদ রানা’র কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যার মূল ভূমিকায় ছিলেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’র কাহিনী রচনা করা হয় এ সিরিজের ‘পিশাচ দ্বীপ’ নামক বই থেকে। ১৯৯৪ সনে প্রচারিত এ নাটকের দুটি মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দর্শকনন্দিত অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত। বর্তমানেও ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রটি আপন আলোয় উদ্ভাসিত যার সর্বশেষ তেজ অনুভব করা যায় ২০১৯ সালে বেসরকারি টিভি মাধ্যম চ্যানেল আই-এর আলোচিত রিয়েলিটি শো ‘মেনস ফেয়ার এন্ড লাভলি চ্যানেল আই হিরো-কে হবে মাসুদ রানা?’ প্রোগ্রামটি আয়োজনের মাধ্যমে। এ সিরিজের মোট বই সংখ্যা প্রায় ৪৬৭ টি।
কুয়াশা ও মাসুদ রানা সিরিজ দুটি বাদেও সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তিন গোয়েন্দা সিরিজ, অয়ন জিমি সিরিজ, কিশোর সিরিজ, গোয়েন্দা রাজু সিরিজ, লোমহর্ষক সিরিজ, এডভেঞ্চার সিরিজ, সেবা রোমান্টিক সিরিজসহ আরও বেশ কিছু পাঠকনন্দিত সিরিজ।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি মাঝে ১৯৬৯-৭০ সনের দিকে সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় রহস্যপত্রিকা প্রকাশের সাথে জড়িয়ে পড়েন যা মাঝে কিছু বিরতি দিয়ে আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
থ্রিলিংধর্মী উপন্যাস লেখার কারণে পাঠক-স্তুতির পাশাপাশি পেয়েছেন মহামূল্যবান পুরস্কারও। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে ১৯৭৪ সনে তিনি বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া পেয়েছেন সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।
স্রোতের বিপরীতে চলতে গিয়ে তিনি একদিকে পাঠকদের নিকট যেমন হয়েছিলেন নন্দিত অন্যদিকে তেমনি সমালোচকদের নিকট হয়েছিলেন নিন্দিত। তৎকালিন সমাজ বাস্তবতায় বেমানান যৌনাচারকে তিনি মাসুদ রানা সিরিজে তুলে ধরেছিলেন বলে সমালোচকরা তাঁর সমালোচনা করে বলেছিল তিনি মাসুদ রানা সিরিজে যৌনতার বেসাতি পেতেছেন। এই সমালোচনার হাওয়া এতোটাই প্রবাহিত হয়েছিল যে সে সময় ‘প্রজাপতি’ মার্কাওয়ালা বই পড়াই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো বাঙালি ঘরে। যারা এসব বই পড়তো তাদেরকে দেখা হতো অন্য নজরে। এছাড়া তিনি ইয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ড সিরিজসহ বিভিন্ন বিদেশী সিরিজ থেকে কাহিনী ধার করে অধিকাংশ সিরিজ লিখেছেন বলেও সমালোচনা আছে। যদিও এসব সমালোচনার বিপরীতে তার মত হচ্ছে রোমাঞ্চধর্মী উপন্যাসের অভিজ্ঞতা নিতেই তিনি এমনটি করেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, কেউ-ই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়; লেখকেরা তো নন-ই। যুগে যুগে এটি প্রতীয়মান হয়েছে যে গতানুগতিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারাই নতুন কিছু সৃষ্টি করেছেন তারাই হয়েছেন সমালোচিত। কিন্তু সবকিছুকে পায়ে ঠেলে তারা ঠিকই আপন মহিমায় হয়েছেন ভাস্বর। কাজী আনোয়ার হোসেন থেকে কাজীদা হয়ে ওঠার গল্পটি তাই প্রায় সবার ক্ষেত্রেই একই। পিতার মতো বিবিধ গুণে গুণান্বিত কাজী আনোয়ার হোসেন ভালবাসেন দেশকে, দেশের মাটি ও মানুষকে। মৃত্যুর পর নিজের অচেতন শরীরকে দান করতে চান তাই ঢাকা মেডিকেল কলজ হাসপাতালে। নিজের এপিটাফের উপর লিখতে চান না একটি শব্দও। স্বপ্ন দেখেন তাঁর মাধ্যমে শুরু হওয়া বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এ থ্রিলিং ধারা কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে না। তাঁর মত কেউ না কেউ এর হাল ধরবে, বাঙালি পাঠক সমাজকে নিয়ে যাবে রহস্যঘেরা অজানা অচেনা ভুবনে, তাঁর মতই হয়ে উঠবে আরেক কাজী-দা।
লেখক – শিপন আলম, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ, রাজবাড়ী।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়