পদ্মা নদীর পারে বৃদ্ধ আকবর আলী মীরের পুথি পাঠের আসর

- Update Time : ১১:১৩:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৪০ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক ছিল পুঁথি পাঠ। সংস্কৃত শব্দ ‘পুস্তিকাথ শব্দ থেকে ‘পুথিথ শব্দটির উৎপত্তি। একটা সময় গ্রাম বাংলার মানুষের আনন্দের উৎস ছিল এই পুথি পাঠ। অথচ কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার সেই ঐতিহ্য। বিলুপ্ত প্রায় সেই পুঁথি পাঠ করে এখনো গ্রামের সাধারণ মানুষদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা, ইতিহাস ও বিভিন্ন সচেতনতামূলক জ্ঞানদান করে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ব্যাপারী পাড়ার আকবর আলী মীর মালত।
আকবর আলী মীর মালতের বয়স প্রায় ৮০ বছর। এখনো তিনি ছুটে চলেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।তিনি রাজবাড়ীর প্রত্যন্ত গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের এক নম্বর ব্যাপারী পাড়ার বাসিন্দা। কয়েকবার নদী ভাঙনের পর এখন এই ব্যাপারী পাড়ায় এসেছেন। জীবনের ৫০ টি বছর ধরে গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষদের পুঁথি শুনিয়ে আসছেন। পারিবারিক জীবনে আকবর আলীর স্ত্রী, ২ ছেলে ও ৩ জন কন্যা সন্তান। কৃষি কাজ করেই চলে তার সংসার। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাতের পর রাত তিনি কাটিয়েছেন পুঁথি পাঠ করে।
গত বৃহস্পতিবার পদ্মা নদীর পারে আয়োজন করা হয়েছিল পুথি পাঠের। পুথি পাঠ শুনতে গিয়েছিলাম গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের সহকারী অধ্যাপক আওয়াল আনোয়ার, সহকারী অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম, স্টেশন মাষ্টার, এবং এই গ্রামের সন্তান সুজাত শেখ। পুথি পাঠ শুনতে শুনতে হারিয়ে গিয়েছিলাম বাংলা সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া সেই অতল গহ্বরে।
শখের বসে পুঁথিপাঠ করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানো আকবর আলী মীর মালত জানান, বাল্য শিক্ষার গন্ডি তিনি ছাড়াতে পারেননি। একুশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন উপজেলার বাহাদুর পুর একটা শিক্ষিত পরিবারে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে বৌয়ের বোনেরা ইয়ার্কি করতো পড়াশোনা নিয়ে তারপর সেই বয়সে অনেকটা জিদ করেই বাড়িতে পড়াশোনা শিখেন এবং শুরু করেন পুথি পাঠ করা।
তারপর শুরু হয় পুথি পাঠ। তার গলায় সুর ছিল। একটা সময় তিনি পুথি পাঠ শুরু করলে অনেক দুর থেকে শোনা যেত সবাই বুঝতো আকবর আলী মীর মালত পুথি পাঠ করছে। তিনি হারনো সেই স্মৃতি রোমোন্থন করতে করতে বলেন তখন পুঁথি পাঠ সাধারণত রাতের বেলা অনুষ্ঠিত হতো। সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অবসর সময়ে কোনো এক আঙিনায় জড়ো হতো। তার পর সেখানে উপস্থিত হতো পুঁথিপাঠক। অনেক পুঁথিসাহিত্য বাংলায় নামকরা ছিল। কারবালা প্রান্তর, বাহরাম বাদশা, লাইলি মজনু, ইউসুফ জোলেখাসহ বহু পুঁথিসাহিত্য ছিল; যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আগে থেকেই তারা ঠিক করে নিত কোনো পুঁথিটি পাঠ করবে। জানাযায় একেকটি পুঁথি শেষ করতে মাসখানেক বা তার বেশি সময়ও লেগে যেত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা থেকে শুরু করে, মুরুব্বিরা এবং মহিলারাও পুঁথি শুনতে আসত। যে বাড়িতে পুঁথিপাঠ করা হতো শুধু সে বাড়ির নয়, এ শ্রোতা থাকত আশপাশের অনেক বাড়ির মানুষজন। সবাই নির্ধারিত সময়ে পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসত। হারিকেনের টিমটিমে আলোয়, জলচৌকিতে পুঁথি রেখে পাঠক আসন করে বসত। চার দিকে সবাই নীরব। তার পর সুর করে পাঠ চলতে থাকত। কয়েক লাইন পড়ে পাঠক থামতেন এবং এর মর্মার্থ উপস্থিত পাঠকবৃন্দকে বুঝিয়ে দিতেন। পুঁথিপাঠের কথা শুনে কখনো হেসে কুটি কুটি হয়েছেন দর্শক, কখনোবা চোখের কোণে জমেছে অশ্রু। পুঁথিপাঠের মাঝখানে থাকত বিরতি। পাঠককে চা করে এনে দিত। সাথে উপস্থিত দর্শকরাও চা পান করত। সাথে একটু পান বা তামাকের ব্যবস্থা করা হতো। বিরতির পর আবারো শুরু হতো পুঁথিপাঠ। রস-রসাত্মক, হাসি-ব্যঞ্জনায় ভরে থাকত পুঁথি পাঠের পুরো সময়। রাত যত গভীর হতে থাকত পুঁথিপাঠ ততই জমে উঠত। ছোট শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ত মায়ের কোলে। বসার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও চাটাই বিছানো থাকত, কখনো আরেকটু আরামপ্রিয় করার জন্য খড় বিছিয়ে নেয়া হতো। পাঠক নানান কথা দিয়ে বর্ণনা করে পুঁথিপাঠের পুরো সময়টিকে মাতিয়ে রাখতেন। গ্রাম-বাংলার প্রতিদিনের অঘোষিত একটি সময় থাকত এই পুঁথিপাঠের জন্য। সে সময়ে সবাই পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসত। এটি প্রতিবেশীদের সাথে একটি সম্পর্কের সেতুবন্ধনও বলা যেতে পারে। এ বাড়ির ও বাড়ির মানুষের খোঁজখবর নেয়ারও একটা মাধ্যম ছিল পুঁথিপাঠের আসর। কে এলো, কে এলো না, কেন আসেনি, কেউ অসুস্থ কি না এমন খোঁজখবরের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি আরো সুদৃঢ় হতো। এখানে কত অজানা কাহিনী উন্মোচিত হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা তখন এ পুঁথিপাঠ শুনতে আসত। পুরোপুরি মর্মার্থ না বুঝতে পারলেও আনন্দ পেত এবং এ সময়টা তারা অন্য কোনো কাজে অপব্যয় না করে বিনোদনের মধ্য দিয়ে কাটাত। পুঁথিপাঠ তখনকার দিনের একটি বিনোদনেরও মাধ্যম ছিল। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সে দিনের আসরটা আরো বেশি জমজমাট হতো। বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পুঁথিপাঠের অনুষ্ঠানে মজাদার খাবারেরও আয়োজন থাকত। হারিকেনের টিমটিমে আলোর সাথে আসমানে উঁকি দিত আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁকে দিয়ে এক চিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথিপাঠের আসরকে আরো মোহনীয় করে তুলত। এমনি কত হাসি কান্নার ভেতর দিয়ে যে একটি পুঁথি শেষ হতো তা বলা কঠিন। এই পুঁথিপাঠের আসরে এসে একেকটি পরিবারের সাথে গড়ে উঠত দৃঢ় সম্পর্ক।
সেই সময় পুথি পাঠ করে বাড়ি আসার সময় মা পালানে হারিকেন ধরে দাড়িয়ে থাকতো বলতো আমার আকবর আসতেছে। আমার কন্ঠ অনেক দুর থেকেই শোনা যেত। পুথি পাঠ বন্ধ হলে মা বুঝতো আমি এখন বাড়ি আসবো।
তিনি আরোও জানান, গ্রামে কোন নবজাতক শিশু জন্মালে ওই শিশুর ৬ দিন বয়সে একটি উৎসব হতো। সেই উৎসবে ডাক পড়ত তার। নবজাতককে সামনে রেখে পুঁথিপাঠ করলে ওই শিশু বড় হয়ে ভাল চরিত্র ও শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হবে এমনটাই ধারণা ছিল তখন। গ্রামের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে তিনি কালু গাজী, ছয়ফুল মল্লুক বদিউজ্জামান, সোনাবানু, জঙ্গে কারবালা, লাইলী মনজু, আওলিয়া নিজাম উদ্দিনসহ প্রায় শত খানেক পুঁথি তিনি পাঠ করে থাকেন। এছাড়াও সপ্তাহে দুই তিনদিন তার নিজ বাড়িতে চলে পুঁথি পাঠের আসর। পুঁথি শুনতে বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষ জড়ো হয় তার বাড়িতে।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়