আজ ইলা মিত্রের প্রয়ান দিবস : লেখক – শারমিন রেজা লোটাস
- Update Time : ০৮:৩২:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৩
- / ১১৯ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
ইলা মিত্রের স্বপ্ন ছিল সফল বিপ্লবের, যে বিপ্লব বৈষম্য পীড়িত সমাজ পাল্টে দেবে; অবসান ঘটাবে শোষণের। এবং তা শুধু ভারত বর্ষেই নয়; গোটা বিশ্বের; এমনকি দরিদ্র বিশ্বের দেশে দেশে। সময়ের টানে ইলামিত্র হয়ে ওঠেন বিপ্লবের দূত। যে জন্য জেল-জুলুম-হুলিয়া কোনো সমস্যা হয়ে ওঠে না।
ইলামিত্র একটি নাম। একটি বিপ্লবের নাম; দর্শনের নাম। নারী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, সাঁওতাল আন্দোলনের লড়াকুর নাম। ইলামিত্র, নাচোলেররানীমা; তেভাগা আন্দোলনের লড়াকু বিপ্লবী; সাঁওতালদের একান্ত আপন জন। তিনি গরীব-দুঃখী সাঁওতাল কৃষকদেরকে জোতদার, জমিদার ও মহাজনদের শাসন-শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প নিয়ে লড়াই করেছেন। সাঁওতালদের কাছে ইলামিত্র ছিলেন মায়ের মতো। তাই তারা তাঁকে ‘রানী মা’ বলে ডাকতেন। কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ বলতে সাঁওতালরা রানী মাকেই বুঝতেন। তাঁদের সব সুখ-দুঃখরা নীমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতেন। আর রানী মা-ও তাঁদের নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। সাঁওতালরা এবং রানী মা ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। নাচোলের তেভাগা আন্দোলন ও ইলামিত্র একই সূত্রে গাঁথা। শুধুতাই নয়; ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি জীবন বাজি রেখে লড়েছেন।
ইলামিত্র জন্মে ছিলেন কলকাতায়; ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীন বাংলার অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। ইলামিত্রের আদি বসতি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার কর্ম সূত্রে তাঁরা কলকাতায় বসবাস করতেন। কলকাতা শহরে ইইলার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কাটে। লেখাপড়ার হাতে খড়ি পরিবারে। তার পর কলকাতার বেথুন স্কুল ও কলেজে। কলেজ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভর্তি হন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলায়ও তুখোড় ছিলেন। ১৯৩৫-৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে, যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যায়। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ১৯৩৬-৪২ সালের মধ্যে তাঁর নাম সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
ইলামিত্র বেথুন কলেজে পড়াশোনা করার সময় নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হন। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে মহিলা সমিতির আন্দোলনে তিনি একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নারী আন্দোলনে যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন।
১৯৪৫ সালে ইলামিত্রের বিয়ে হয় বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা রমেণ মিত্রের সঙ্গে। বিয়ের পর কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুর বাড়ি রাম চন্দ্রপুর হাটে। রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের নিয়মানুসারে অন্দর মহলেই থাকতেন ইলামিত্র। এ সময় রমেণমিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়া কৃষ্ণ গোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলেন। রমেণ মিত্রের কাছে গ্রামের সবাই দাবি জানালেন, তাঁদের নিরক্ষর মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে বধূমাতা ইলামিত্রকে। অনুমতি পেলেন ইলামিত্র। মাত্র তিন জন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হলো। তিন মাসের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ জনে।
ইলামিত্র ও তাঁর স্বামী দু’জনই মার্কসবাদের রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। মার্কসবাদই একমাত্র নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত মানুষের মুক্তির পথ। মার্কসবাদই পারে সারা বিশ্বের মানুষকে মুক্তি দিতে। আর রমেণমিত্রের একান্ত সহযোগিতায় ইলামিত্র হয়ে ওঠেন ‘রানী মা’; তেভাগা আন্দোলনের লড়াকু যোদ্ধা।
রমেণমিত্রের কাছে তিনি জমিদার ও জোতদারের হাতে বাংলার চাষিদের নিদারুণ বঞ্চনা, শোষণ এবং শোষণের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলনের বীরত্বপূর্ণ কাহিনি শোনেন। অনেক আগে কমিউনিস্ট রমেণ মিত্র জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য ও মোহত্যাগ করে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রমেণমিত্র ইলামিত্রকে এসব কাজে উৎসাহ দেন। ১৯৪৬-৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইলামিত্র।
বিভিন্ন শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। যার ফলে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্বভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় ‘ফাউন্ড কমিশন’। এ কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগের মালিকানা প্রদান। এ সুপারিশ বাস্তবায়নে কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চল্লিশের দশকে এসব আন্দোলনে ইলামিত্র নেতৃত্ব দেন।
১৯৪২-৪৩ সালে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। এ সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তিন ভাগের দুই ভাগ ফসল- কৃষকের এ দাবি নিয়ে বেগবান হতে থাকে তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজি দানেশের প্রচেষ্টায় সংগঠিত হয় যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি চাষিদের সংগঠিতকরে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। পার্টি থেকে রমেণমিত্র ও ইলামিত্রকে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তেভাগা আন্দোলনকে জোরদার করতে বলা হয়। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করতে এগিয়ে আসে। এ সময় ইলামিত্র নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্তগ্রাম হাসনাবাদে পুনর্বাসন কাজে চলে যান।
১৯৪৮ সাল। ইলামিত্র অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান প্রসবের জন্য তিনি গোপনে কলকাতায় যান। পুত্র সন্তনের জন্ম হয়। এক মাস বয়সের ছেলেকে শাশুড়ির কাছে (রামচন্দ্রপুর হাট) রেখে তিনি ফিরে যান নাচোল। ১৯৪৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে হাজার হাজার ভূমিহীন কৃষক সংগঠিত হয়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে জোতদার, মহাজনের দল। ওই বছর কৃষকের ধান জোতদারদের না দিয়ে সরাসরি কৃষক সমিতির উঠোনে তোলা হয়। ফলে সংঘর্ষ বাধে। নাচোলে সাঁওতাল ও ভূমিহীনদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী তীরন্দাজ ও লাঠিয়াল বাহিনী। এ বাহিনীর প্রধান ছিলেন মাতলা মাঝি। এভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ইলামিত্র ও রমেণমিত্র। নাচোল অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের বাস্তবরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা।
মানুষে-মানুষে প্রীতি, শ্রদ্ধা বা বন্ধুত্বের শুদ্ধ সম্পর্ক যে মানব চেতনার শ্রেষ্ঠ সম্পদ- এটা ইলামিত্র জানতেন ও বুঝতেন, কট্টর মতাদর্শবাদীরা যা জানেননা বা বোঝেন না। ইলামিত্র এ মানবীয় মূল্য বোধের দাম দিতে পেরেছেন। এ সত্য জানতেন রমেণমিত্র; বুঝতেনও। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক উজ্জ্বলতা সৃষ্টিও মানসিক মূল্যবোধের বিকাশ যাঁদের লক্ষ্য, তাঁরা কেন ব্যক্তি-সম্পর্ককে মূল্য দেবেন না- এ রহস্য তাঁরা ঠিক বুঝে উঠতে পেরেছিলেন। এগুলোর সঙ্গে তো ব্যক্তি-সম্পর্কের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। ব্যক্তিকে নিয়েই তোসমষ্টি। মতাদর্শগত রাজনীতিতে একনিষ্ঠ এরা দু’জন মানসিকতা ও জীবন বোধের দিক থেকে আর দশজন রাজনৈতিক নেতা বা সাংস্কৃতিকধীমান থেকে ভিন্ন ছিলেন। উদারমানবীয় মূল্যবোধ তাঁদের চেতনা ও জীবন ধারায় গভীর ছাপ এঁকে স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছিল। অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গুলো তাঁদের হৃদয়ের উষ্ণতায় সজীব থেকেছে। এমন নিকট-সজ্জনের স্মৃতি কখনও হারিয়ে যায় না।
নাচোলের হারনা-মানা, উপমহাদেশে নারী জাগরণ ও কৃষক আন্দোলনের এ কিংবদন্তি কৃষক নেত্রী ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর মারা যান। জয়তু ইলামিত্র।
লেখক – শারমিন রেজা লোটাস, সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাজবাড়ী জেলা শাখা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়