“আত্মভোলা এক মানুষ”- ড. কাজী মোতাহার হোসেন (তৃতীয় পর্ব) – লেখক: শিপন আলম
- Update Time : ১০:৫৯:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল ২০২২
- / ৩০ Time View
রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
ড. কাজী মোতাহার হোসেনের পঞ্চম কন্যা হচ্ছেন সনজীদা খাতুন যিনি ছায়ানটের বর্তমান সভাপতি ও সম্প্রতি পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনি তাঁর ‘আমার আব্বু’ রচনায় কাজী সাহেবের ভুলোমনা স্বভাবের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন- ‘ভুলো স্বভাবের মজা দেখেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। একদিন বিকেলে খুব হুড়োহুড়ি করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলেন কোনও সভাতে বক্তৃতা করতে। রাত্রে ফিরবার সময় কোমরের কাছটা বার বার টানছেন ওপর দিকে। বিষয় কি? আমার কন্যা ‘কি হয়েছে নানা?’ বলে কাছে গিয়ে দেখে তাড়াহুড়োতে লুঙ্গির নিচ দিয়ে পাজামাটা পরেছিলেন ঠিকঠাক, শুধু লুঙ্গিটা নামিয়ে রাখবার খেয়াল হয়নি। সভাস্থলে সারাক্ষণ নিশ্চয়ই লুঙ্গিটাকে টেনে টেনে কোমরের কাছে রাখতেই ব্যাপৃত থাকতে হয়েছিল।’
মরহুম মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ছিলেন কাজী সাহেবের মেজ মেয়ে ওবায়দা সাদের দেবর এবং দীর্ঘ দিনের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। ১৯৪২ সাল থেকে মোতাহার হোসেন সাহেবের সাথে তার পরিচয়। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক- কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আমোদ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। কাজী সাহেবের সাথে তার একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় স্কাউট জাম্বুরীর প্রধান হিসেবে কাজী সাহেব কুমিল্লায় যান। কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌছালে ফজলে সাহেবসহ আরও অনেকেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যান। কথার এক পর্যায়ে কেউ একজন ফজলে সাহেবকে কাজী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে আত্মভোলা কাজী সাহেব হেসে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ,রাব্বী সাহেব তো আমার ক্লাস ফ্রেন্ড ছিলেন।’ এ কথা শুনে ফজলে সাহেবের তো তখন হতবিহ্বল অবস্থা। পরিস্থিতি কোনমতে সামলে তিনি ঘরে ফিরে খুব চেষ্টা করে নতুন করে নিজের পরিচয় দেন এবং তার ক্লাসফ্রেন্ড রাব্বী সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি ঠিক ছোট্ট শিশুর মত জবাব দেন, ‘কেন, ফরিদপুরের নবাব ফজলে রাব্বী তো আমার ক্লাস-ফ্রেন্ড ছিল।’ কাজী সাহেবকে নিয়ে তার লেখা ‘স্মৃতি অনির্বাণ’ রচনায় ফজলে রাব্বী সাহেব এ মজার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
সব দম্পতির মধ্যেই মান অভিমান চলে, রাগ অনুরাগ চলে। মান অভিমানের সেই সময়ে দুজনের মধ্যে সাময়িক কথা বলা বন্ধ থাকাও তাই অস্বাভাবিক নয়। কাজী দম্পত্তির এই মনোমালিন্য নিয়েও আছে মজার ঘটনা। এই মনোমালিন্যের মধ্যেই আছে ভুলোমনা স্বভাবের আরেক মোতাহার হোসেন।
একবার কাজী দম্পতির মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। তাই তাদের মধ্যে বাক্যালাপও বন্ধ ছিল। কাজী সাহেব সাধারণত খাবার খাওয়া শেষে বই পড়তেন আর মিসেস কাজী কাছে বসে বড় এলাচ ছাড়িয়ে তাঁকে দুই একটা খেতে দিতেন। কিন্তু সেবার যেহেতু মনোমালিন্য চলছিল তাই মিসেস কাজী বিষন্ন মনে একাই এলাচ খাচ্ছিলেন আর পাশে বসে কাজী সাহেব মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করছিলেন কখন ঘরণী তাঁর ওপর দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে দুই একটা খেতে দিবেন। কাজী দম্পতির চতুর্থ কন্যা জাহেদা খাতুন তাঁর ‘আব্বুর স্মৃতি’ নামক স্মৃতিকথায় এ ঘটনার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন- ‘আব্বু কিন্তু মনে মনে আশা করছিলেন আম্মু বুঝি ওনার দিকেও দু’একটা দেবেন। এমন সময়ে
একটা গুবরে পোকা ঠকাস করে আব্বুর সামনে এসে পড়ল। অমনি আব্বু মনে করলেন এলাচ, তাই তুলেই মুখে পুরে দিলেন। আম্মু ত হেসেই খুন! আব্বু-আম্মুর মিলিত হাসিতে গুমোট পরিবেশ হালকা হলে আমার খুব ভালো লেগেছিল।’
সনজীদা খাতুনও তার ‘আমার আব্বু’ রচনায় এ ঘটনার বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘একবার বারান্দায় মাদুর পেতে বাতি জ্বেলে বসে আব্বু লেখাপড়া করছিলেন। আম্মু তখন খেয়ে উঠে দূরে মোড়ায় বসে এলাচ খাচ্ছেন। হঠাৎ কি একটা মাদুরের ওপরে ছিটকে পড়তেই আব্বু চট করে তুলে মুখে পুরে চিবিয়ে ফেললেন। তাই দেখে আম্মু হো হো করে হেসে উঠেছেন। মুখে পুরেছেন গুবরে পোকা! ভেবেছিলেন আম্মু বুঝি এলাচ ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দিয়েছেন ভাব করবার জন্য! এতেও অবশ্য ভাব হয়ে গেল, তবু হেনস্থাও হলো আব্বুর!!’
সাহিত্যিক সরদার জয়েন উদ্দীন ড. কাজী মোতাহার হোসেনের খুব স্নেহধন্য ছিলেন। সরদার জয়েন উদ্দীন যখন জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক ও ‘বই’ পত্রিকার সম্পাদক ঘটনাটি তখনকার। একবার ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বইয়ের ওপর প্রশংসাসূচক ‘বাজে সমালোচনা’ পড়ে তিনি খুবই রাগান্বিত হোন। রাগের কারণ হচ্ছে তিনি অর্থ খরচ করে এমন বাজে একটি বই কিনেছেন এবং সময় নষ্ট করে পড়েছেন। এর চেয়ে অন্য একটি ভালো বই তিনি কিনতে পারতেন- এতে করে তাঁর সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হতো। আর এ কারণেই সরদার জয়েন উদ্দীনের ওপর রাগ ও ক্ষোভ ঝাড়ার জন্য তিনি তার অফিসের দিকে রওনা হোন। কিন্তু দুঃখের বিষয়- পথ চলতে গিয়ে তিনি তার অফিসের নাম ও ঠিকানা এমনকি তার নামটি পর্যন্ত ভুলে যান। ফলে ঐ অফিস পার হয়ে তিনি সোজা চলে যান দৈনিক বাংলা অফিসে। সেখানে গিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন- ‘আচ্ছা, রওশন ইয়াজদানীর অফিসটা এখানে কোথায়?’ দৈনিক বাংলা অফিসের লোকজন তাঁকে জানান- ‘স্যার, ইয়াজদানী তো দৈনিক আজাদে চাকরি করতেন আর তিনি তো অনেক আগেই মারা গেছেন।’ অগত্যা তিনি নিরুপায় হয়ে আবার বলেন- ‘ওই যে ‘বই পড় বই পড়’ বলে সভা সমিতি করে তার কথা বলছি।” তখন তারা বলেন- ‘সে তো গ্রন্থ কেন্দ্রের সরদার জয়েন উদ্দীন।” তখন তিনি সলজ্জভাবে স্মিত হেসে বলেন- “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তার কথাই বলছি।’ তখন তারা লোক দিয়ে কাজী সাহেবকে তার অফিসে পাঠিয়ে দেন।
লেখক: শিপন আলম, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়