“বটগাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, শুধু নানু নেই” –
ছোট বেলায় যখন নানুবাড়ী বেড়াতে যেতাম অনেক মজা হতো। বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন কিলো দুরে ছিল নানুবাড়ী। বাস থেকে নেমে যানবাহন বলতে ছিল শুধু পা চালিত রিকশা। রিক্সায় উঠে অপেক্ষার পালা কখন আসবে সেই বটগাছ টি। কারণ নানুবাড়ীর কাছেই ছিলো একটা বিশাল বড় বটগাছ। দুর থেকে গাছটি দেখলেই বুঝতে পারতাম আর বেশী দেরি নেই নানুর কাছে যেতে। অবশেষে নানুবাড়ী চলে আসতো। রিকশা থেকে নেমেই দোউড়ে গিয়ে নানুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতাম। এই কান্নাটা ছিল আনন্দের কান্না।
কোন রকম একটু নাস্তা করেই ছুটে চলে যেতাম পুকুরে গোসল করার জন্য। আম্মা বারবার বলে দিত এই বেশি দেরি করবিনা কিন্তু, কে শোনে কার কথা। চোখ দুটো লাল না হওয়া পর্যন্ত উঠতাম না পুকুর থেকে। তারপর হতো দুপুরের খাবার আয়োজন। নানু দারোগার মতো টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমার মামি আমাদের ঠিক মতো খাবার গুলো দিচ্ছে কি না, আমরা সব কিছু খাচ্ছি কি না সব দেখতো। এখন নানুবাড়ী গেলে যখনই টেবিলে খেতে বসি নানুর অমন দাঁড়িয়ে থাকাটা মনে পরে যায়, আর আনমনে চোখে পানি চলে আসে। খাবার পরে মামার আদেশ ছিলো ঘুমাতে হবে। ঘুম কি আর আসে অনেক কষ্টে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতাম। মামা এসে বলতো “যার পা নড়বে সে ঘুমিয়েছে, সবাই পা নাড়াতাম”। মামা বলতো হুম সবাই ঘুম। এখন সেই কথা গুলো মনে পরলে একাই হাসি, সত্যি কি বোকাটায় না ছিলাম আমরা।
বিকেল হলেই এ মাঠে, সে মাঠে ছুটাছুটি। সন্ধ্যায় উঠানে পাটি বিছিয়ে নানু আমাদের সবাই কে গল্প শোনাতো। আমরা গল্প শুনতাম আর মজার মজার পিঠা খেতাম। পিঠা এখনো গেলে মামি খাওয়ায়। তবুও নানুকে খুব মিস করি। রাতে খাবার পরে শুরু হতো নানুকে নিয়ে টানাটানি কে ঘুমাবে নানুর কাছে, উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল একটাই যে নানুর কাছে ঘুমাতে পারবে সে বেশি হাত পাখার বাতাস পাবে। অবশ্য অবশেষে আমিই পেতাম নানুর কাছে ঘুমানোর সুযোগ। এভাবেই কেটে যেত নানুবাড়ির মধুর সময়। নানু আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে প্রায় ৫ বছর। না ফেরার দেশ থেকে আর কখনো তিনি ফিরে আসবেন না। এখনো নানু বাড়িতে পৌছানোর আগে সেই বটগাছ টার অপেক্ষায় থাকি। ছোট বেলায় যেখানে ছিল, ঠিক ওখানেই এখনো একভাবে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা, তবে তার ও যে এখন বয়স হয়ে গেছে বোঝা যায়। হয়তো কোন এক সময় গেলে দেখবো গাছটিও আর নেই আমার নানুর মতো হারিয়ে গেছে। ভালোবাসার বন্ধন গুলো এমনই হয়। একটা সময় সুতো কেটে দিয়ে আপনজনদেরকে অনেক একা করে দিয়ে যায়। তবুও আমরা সবাই সবাইকে ভালোবাসি ভালোবাসবো অনন্তকাল।
লেখক- সোমা ইসলাম, বড়পুল, রাজবাড়ী।