সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমঃ প্রেক্ষিত শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠন –

রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
মার্ক জুকারবার্গের ফেসবুক, জ্যাক ডরসির টুইটারসহ অন্য সামাজিক মাধ্যমগুলো বর্তমান বিশ্বের শিক্ষিত ও সচেতন প্রায় সকল মানুষকে নাড়া দিয়েছে।পৃথিবীর প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ (যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০%) এসকল মাধ্যম ব্যবহার করছে।এসব জাদুকরী মাধ্যম অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রায় পুরো বিশ্ব ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে।যার দরুণ আরব বসন্তের মত ঘটনা ঘটেছে। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে তার পশ্চাতেও রয়েছে এসব মাধ্যমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। বিভিন্ন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও এসব মাধ্যম বর্তমানে একটি বড় প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।
সামাজিক মাধ্যম যে শুধু বয়স্কদের চিন্তা ভাবনায়ই পরিবর্তন সাধন করছে তা কিন্তু নয় এটি প্রায় সব বয়সী মানুষকে এমনকি শিশুদেরও শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনেও প্রভাব রাখছে।
শিশুরা হলো অবারিত প্রকৃতি।খোলা আকাশের মতই প্রশস্ত তাদের মন। তাদের মন কাদা মাটির মতই নরম। একটি সুন্দর শৈশব সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহার তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের এ ভিত্তি গঠনকে শুধু বাধাগ্রস্থই করছে না বরং অনেক ক্ষেত্রে তা ধবংসের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
আগে শিশুরা বেড়ে উঠত যৌথ পরিবারে। বাবা- মা, ভাই-বোন এর পাশাপাশি সেখানে সে খেলার এবং সময় কাটানোর জন্য সাথী হিসেবে পেত দাদা-দাদী, চাচা-চাচী,চাচাতো ভাই-বোন ও পাড়া প্রতিবেশীদের। ফলে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো সে হাসি আনন্দে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ধূলো-বালি নিয়ে খেলতে খেলতে বেড়ে উঠত। একসাথে অনেক মানুষের সাথে মেশার ফলে ছোটবেলা থেকেই সে হয়ে উঠত খুবই মিশুক স্বভাবের। সংসারের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সে প্রত্যক্ষ করত। ফলে তার মধ্যে তৈরি হত একটি সহানুভূতিশীল হৃদয়।কিন্তু যুগের প্রয়োজনে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরিত হয়েছে। বাবা-মা দুজনই হয়েছেন কর্মমুখী। কর্ম ব্যস্ততার কারণে তারা বাচ্চাদের ঠিক মত সময় দিতে পারছেন না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তারা বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ইউটিউব, ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে। ফলে শিশুর দুনিয়া হয়ে যাচ্ছে সংকীর্ণ। বিকশিত হচ্ছে না শিশুর সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো। ইচ্ছেরা মেলছে না ডানা। তার চোখ ও মন পড়ে আছে স্মার্টফোনের কয়েক ইঞ্চি ডিসপ্লেতে। ভেতরে যা দেখছে তা তার হৃদয়ে এক প্রকার ফ্যান্টাসি তৈরি করছে যা বাস্তবে কখনো সম্ভব নয়। এভাবেই সে কল্পনার সাথে বাস্তবতাকে গুলিয়ে ফেলছে। যা তার বাস্তবতা নির্ভর জীবন গঠনে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
অনেক বাবা-মাকেই ইদানিং দেখা যায় শিশু ভূমিষ্ঠের সাথে সাথে তার জন্য ফেসবুকে একাউন্ট খুলতে। তার নানা বিষয় ফেসবুকে শেয়ার করা হয় অথচ শিশুটি কিছুই জানে না। পরবর্তীতে যখন সে জানতে পারে তখন সেটি ব্যবহারে সে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তাছাড়া সামাজিক মাধ্যমে শিশুর বিভিন্ন তথ্য শেয়ার শিশুটিকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও ফেলে দেয় কেননা অপরাধীরা ঐ শিশু সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য তারা এসব মাধ্যম থেকেই পেয়ে যায়।
নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি এসবের ব্যবহার একজন শিশুর চোখের সমস্যা,আঙুলের সমস্যা,কব্জির সমস্যাসহ নানা রকম শারীরিক সমস্যার মধ্যে ফেলে দেয়। স্মার্টফোনগুলো টাচনির্ভর হওয়ায় এগুলোর ইমেজ ও ভিডিও দ্রুত এদিক সেদিক মুভ করা যায়।ফলে শিশুদের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা তৈরি করে যা পরবর্তীতে তাকে অসহিষ্ণু করে তোলে।
অতিমাত্রায় সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার শিশুর ভাষা শিক্ষায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব মাধ্যমে অডিও ভিডিওগুলো কখনো বাংলা, কখনো ইংরেজি, কখনো হিন্দী বা কখনো আরবি ভাষায় প্রচার হয় ফলে শিশুটি কোন ভাষা গ্রহণ করবে তা বুঝতে পারে না। একারণে তার প্রমিত উচ্চারণে ভাষা শিখতে বিলম্ব হয় অথবা অনেক সময় স্পষ্ট উচ্চারণে ভাষা শিক্ষাটা তার জন্য দুরূহ হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় মডেল শাহতাজ এক সাক্ষাৎকারে তার শব্দ উচ্চারণ অনেকটা কার্টুন চরিত্রের মত কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন ছোটবেলায় অনেক কার্টুন মুভি তিনি দেখেছেন ফলে তার উচ্চারণ অনেকটা কার্টুন চরিত্রের উচ্চারণের মত হয়ে গেছে।
ফেসবুক এর প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ তার ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ‘মেসেঞ্জার কিডস’ নামে একটি অ্যাপ চালু করেছেন যা শিশুদের বাবা-মায়ের অনুমোদন সাপেক্ষে তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। পাশাপাশি পরিচিত জনদের সাথেও তারা মেসেজিং করতে পারে। এতে ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুরা তাদের কনটাক্টগুলোর সঙ্গে ছবি, ভিডিও আর টেক্সট মেসেজ আদানপ্রদান করতে পারে। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে সম্প্রতি একদল মার্কিন শিশু কল্যাণ বিশেষজ্ঞ মার্ক জুকারবার্গের কাছে একটি চিঠি লেখেন। এতে তারা বাচ্চাদের এ মেসেজিং অ্যাপটি বন্ধ করে দেবার আহ্বান জানান।
শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে; সুন্দর সুস্বাস্থ্যে,মেধা ও মননে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক সৌহার্দ্য ও মজবুত বন্ধন; নিশ্চিত করা প্রয়োজন নির্মল বিনোদন নির্ভর শৈশব; প্রয়োজন মুক্ত মাঠ, অবারিত প্রকৃতি। স্মার্টফোন নির্ভর সামাজিক মাধ্যম এক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে কিন্তু কখনোই বিকল্প হতে পারে না। এক্ষেত্রে বাবা-মা, আত্মীয় পরিজনদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক- শিপন আলম, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ ।