শিক্ষকদের কল্যাণে রাজবাড়ীর অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পকেট কেটে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য-

- Update Time : ১০:২৯:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ মে ২০১৮
- / ১৪ Time View
জাহাঙ্গীর হোসেন, রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করে বোর্ড কর্তৃক সরবরাহকৃত বইকে দুরে ঠেলে শিক্ষাকদের কথিত কল্যাণের লক্ষে রাজবাড়ীতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পকেট কেটে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করা হয়েছে। শিক্ষক সমিতির নেতারা বলছেন, এটা ঘুষ নয়, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা একটা পদ্ধতী। তারাও সে পদ্ধতী অনুসরণ করছেন এবং আয় হওয়া টাকা তারা শিক্ষকদের কল্যানেই ব্যয় করছেন।
জানাগেছে, দেশে শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং ঝড়ে পড়া রোধ করতে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই সরবরাহ করছে সরকার। সরকারের এই অর্জনকে পদ দলিত করতে কথিত শিক্ষক সমিতি গুলো উঠে পরে লেগেছে। তারা বোর্ড কর্তৃক সরবরাহকৃত ওই সব বইয়ের মধ্যে ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণকে অনৈতিক আয়ের প্রধান উৎস্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। প্রকাশ্য শিক্ষার্থীদের ওই বই দু’টি পড়তে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে বোর্ডের ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পড়ার কোন দরকার নেই। বিদ্যালয় থেকে বলে দেয়া কোম্পানীর বই কিনে নিয়ে স্কুলে আসতে। আর বই না কিনলে শিক্ষার্থীদের বলা হচ্ছে কুট কথা। সেই সাথে সুকৌশলে অভিভাবককে বলা হচ্ছে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী বাইরের বই গুলো না কিনলে, শিক্ষা গ্রহণে পিছিয়ে পরবে আপনার সন্তান।
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা শহরের রিকশা চালান লালন মিয়া। তার দুই ছেলে। এক জন সপ্তম শ্রেণীতে, অপরজন নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। সারা দিনের রোজগার দিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের মুখের আহার জোগার করতেই তিনি হিমসিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে ঝড়ে তার রান্না ঘর ভেঙ্গে গেছে। ওই ঘর সারাতে লাগবে কম করে তিন হাজার টাকা। গত কয়েক দিন ধরে ছেলেরা ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ কিনে দিতে মাথা খারাপ করে ফেলছে। তাদের স্কুল থেকে বলে দিয়ে পুথিনিলয় কোম্পানীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ কিনতে। অনেক কষ্ট করে এক হাজার টাকা জোগার করে দোকানে গেলাম ওই বই কিনতে। সেখানে গিয়ে দেখি সপ্তম শ্রেণীর ওই বই দু’টি সাড়ে ৭ শত টাকা এবং নবম শ্রেণীর বই দু’টি সাড়ে ১১শত টাকা। মোট লাগবে ১ হাজার ৮শত টাকা। ফলে বই না কিনে বাড়ী ফিরে যাচ্ছি। তাই আরো টাকা জোগার করার পর ওই বই কিনতে হবে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলীপুর গ্রামের জেলে প্রকাশ হলদার বলেন, ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে কষ্টের সীমা নেই। কলমের দাম কম থাকলেও গাইড বই, খাতা, প্রাইভেট মাস্টার আর জামা-কাপড় কিনতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশ করছে কি কারণে ? ছেলে মেয়েরা স্কুল থেকে দেয়া ওই বই ঘরে তুলে রেখেছে। এখন বলছে স্কুল থেকে দেয়া পপি লাইব্রেরীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ কিনতে। কোন উপায় নেই। মাষ্টারদের নির্দেশনা মত ধার-দেনা করে টাকা এনে ওই টাকা দিয়ে ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ তাকে কিনে দিতে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, জেলার পাংশা ও কালুখালী উপজেলায় এমপিও ভুক্ত ৫৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ সব বিদ্যালয়ে গড়ে সাড়ে ৩শত জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে। সে হিসেবে ৫৭টি স্কুলে ১৯ হাজার ৯শত ৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ওই সব বিদ্যালয়ে এবার বোর্ড বইকে দুরে ঠেলে রাজধানী ঢাকার পুথিনিলয় কোম্পানীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্য করা হয়েছে। ওই কোম্পানীর ষষ্ঠ শ্রেণীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণের দাম সাড়ে ৬শত টাকা, সপ্তম শ্রেণীর সাড়ে ৭ শত টাকা, অষ্টম শ্রেণীর এক হাজার টাকা এবং নবম শ্রেণীর সাড়ে ১১ শত টাকা দরে বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। এই চার শ্রেণীর বইয়ের দাম গড়ে ৮শত টাকা করে ধরা হলে ১৯ হাজার ৯শত ৫০ জন শিক্ষার্থীর কাছে তারা প্রায় ১৬ কোটি টাকা মূল্যের বই বিক্রি করছে। আর ওই বই বিক্রির জন্য কোম্পানীটি সুকৌশলে অত্যান্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে ৫০ লাখ টাকা প্রদানের চুক্তিও করেছে। ইতোমধ্যেই ওই টাকা পাংশা-কালুখালী উপজেলা শিক্ষা কল্যান ট্রাস্টের নেতৃবৃন্দের কাছে প্রদানও করেছে।
পাংশা-কালুখালী উপজেলা শিক্ষা কল্যান ট্রাস্টের পাংশা-কালুখালী উপজেলা শিক্ষা কল্যান ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম জানান, সরকারী ভাবে দেয়া বোর্ডের ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণে সিলেবাস ভিত্তিক বিষয়াদি এবং বর্ণনা নেই। যে কারণে তারা তাদের ট্রাস্ট ভুক্ত ৫৭টি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার পুথিনিলয় কোম্পানীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্য করেছেন। তবে তিনি কত টাকার বিনিময়ে এই বই পাঠ্য করেছেন তা বলতে অস্বীকার করেন। যদিও এই টাকা তারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কল্যানে ব্যয় করছেন বলে জানান। তিনি আরো জানান, যে কোন শিক্ষার্থীকে আপদকালিন সহায়তা স্বরুপ দুই হাজার টাকা এবং শিক্ষককে ৫ হাজার টাকা তারা প্রদান করে থাকেন। সেই সাথে অবসর ও মৃত্যুবরণকারী তাদের ট্রাস্টের সাথে যুক্ত থাকা শিক্ষককে তারা ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন। তবে তিনি, বোর্ডের বইকে দুরে ঠলে সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করে জোরপূর্বক বাইরে থেকে উচ্চ মূলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বই কিনতে বলাটা কতটা নৈতিক ব্যাপার এমন প্রশ্নের কেন সদুত্তর দিতে পারেনি। যদিও তিনি জানিয়েছেন, তাদের ষ্ট্রাস্টের পক্ষ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা এফবিআর করা রয়েছে।
ওই প্রশ্নের উত্তরে পাংশা-কালুখালী উপজেলা শিক্ষা কল্যান ট্রাস্টের সভাপতি একেএম নজরুল ইসলাম জানান, এক কথায় এটা সরাসরি ঘুষ। বই কোম্পানী আমাদের ঘুষ দিচ্ছে, আর আমরা তাদের বই গুলো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করছি। আমরা মুখে শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা বলছি, অথচ অন্তরে ধারণ করছি না। শতভাগ শিক্ষকই এই অনৈতিক টাকা গ্রহণের পক্ষে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে বিষয়টা কষ্ট দায়ক হলেও একক ভাবে কিছু করার বা বলার নেই।
অপর দিকে, জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত একাধিক পুস্তক প্রকাশক কোম্পনীর চুক্তি হয়েছে। মোটা অংকের চুক্তির বিনিময়ে সেখানকার ৩২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্য করা হয়েছে। তারা জননী পাবলিকেসন্স-এর সাথে ষষ্ঠ শ্রেণীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্য করা এবং সকল ক্লাসের সিলেবাস ও প্রশ্নপত্র কেনার চুক্তি করেছে।
এদিকে, রাজবাড়ী সদর উপজেলার ৪২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবার রাজধানী ঢাকার পপি লাইব্রেরীর ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্য করা হয়েছে। এর জন্য ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছে রাজবাড়ী শিক্ষক-কর্মচারী কল্যান সমিতি।
রাজবাড়ী শিক্ষক-কর্মচারী কল্যান সমিতি সভাপতি ভিপি গাজী আহসান হাবিব ওই টাকা গ্রহণের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষকদের উন্নয়নে তারা নিবেদিত ভাবে কাজ করছেন। বে সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মারা গেলা ও অবসরে গেলে খালি হাতে বাড়ী ফেরেন। যে কারণে তারা শিক্ষকদের কাছ থেকে নিমিত ভাবে বেতন অনুযায়ী চাঁদা সংগ্রহ করেন এবং ওই টাকা আয়বর্ধ্যক কাজে ব্যবহার করেন। বর্তমানে সমিতির নামে তাদের ৫০ লাখ টাকা এফবিআর করা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসার সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান জানান, সরকারী ভাবে বোর্ড কর্তৃক যে বই গুলো শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হয় তাই যতেষ্ঠ। ওই সব বই থেকেই জেএসসি এবং এসএসসি’র প্রশ্নপত্র করা হয়। ফলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চিঠি প্রদানের মাধ্যমে বলা হয়েছে “বোর্ড বইয়ের বাইরে অন্য কোন বই পড়ানো যাবে না। তার পরও গোপনে অন্যকোন ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হচ্ছে কিনা তা তিনি জানেন না। তবে মাঝে মধ্যেই তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয় ও ক্লাস রুম পরিদর্শন করেন। ওই পরিদর্শনকালিন বোর্ডের বইয়ের বাইরে অন্য কোন বই দেখতে পেলে তিনি শিক্ষকদের মৌখিক ভাবে সতর্ক করে আসছেন।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী জানান, এটা সারা বাংলাদেশের চিত্র। আর্থিক সুবিধা নিয়ে গোপন চুক্তি মাধ্যমে স্ব-স্ব বিদ্যালয় অথবা শিক্ষকদের সংগঠন গুলো বোর্ডের বইয়ের বাইরে বিভিন্ন পুস্তক বিক্রেতাদের তৈরী করা ইংরেজী গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ পাঠদান করাচ্ছেন। তবে এ সংক্রান্ত কোন লিখিত অভিযোগ না থাকায় তিনি কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছেন না। লিখিত অভিযোগ পেলেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়