দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ পারাপার, ওপরে রংচং ভেতরে জং –
![](https://rajbaribarta.com/wp-content/uploads/2023/08/icon.png)
- Update Time : ০৮:৩৫:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
- / ২৩ Time View
গণেশ পাল ,রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পারাপার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলাচলকারী লঞ্চগুলো অনেক বছরের পুরনো হওয়ায় ওপরে ফিটফাট দেখা গেলেও ভেতরে ইঞ্জিনসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই জোড়াতালি দেওয়া। আবার প্রশিক্ষিত মাস্টারের (চালক) বদলে অনভিজ্ঞ হেলপার দিয়ে অনেক লঞ্চ চালানো হচ্ছে। এদিকে নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিআইডাব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের হলেও অজ্ঞাত কারণে তারা নীরব ভূমিকা পালন করছে।
দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া একটি ব্যস্ততম নৌপথ। এ পথে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার যাত্রী লঞ্চ পারাপার হয়। বর্তমান এখানে ছোট-বড় ৩৩টি লঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি এমভি ও সাতটি এমএল। চলাচলকারী ওই লঞ্চগুলো ৩৫ থেকে ৪০ বছরের পুরনো। এ কারণে প্রায় অকেজো হয়ে পড়া ওই সব লঞ্চের ওপরে চকচকে রঙের প্রলেপ থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিনসহ ভেতরের অনেক যন্ত্রাংশে মরিচা ধরেছে। এসব লঞ্চে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, ফায়ার বাকেট, বালুভরা বাক্স, পাম্প মেশিন, ফার্স্ট এইডসহ জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকার কথা থাকলেও তা নেই। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত চালক না রেখে অনেক লঞ্চ মালিক হেলপার দিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছেন।
এদিকে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া উভয় ঘাটে বিআইডাব্লিউটিএর দুজন ট্রাফিক পরিদর্শক দায়িত্বে রয়েছেন। লঞ্চ টার্মিনালে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থেকে যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু প্রতিবছর দুই ঈদকালীন সময় ছাড়া দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া লঞ্চ টার্মিনালে কোনো ট্রাফিক পরিদর্শকের হদিস পাওয়া যায় না। এ সুযোগে লঞ্চ মালিক ও সংশ্লিষ্ট লোকজন তাদের নিজ নিজ লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে লঞ্চ পারাপার করে।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌ রুটে চলাচলকারী এক এমভি লঞ্চের চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাটুরিয়া ঘাট থেকে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে এমভি মোস্তফা নামের একটি লঞ্চ দৌলতদিয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। মাত্র এক কিলোমিটার দূরে পৌঁছাতেই মালবাহী এক কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চটি উল্টে পদ্মায় ডুবে যায়। এ ঘটনায় নারী-শিশুসহ ৮১ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ছিল ১৪৭ জন। অথচ ওই দিন প্রায় আড়াই শ যাত্রী বোঝাই করে লঞ্চটি পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে গিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, ‘ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করার পাশাপাশি সামান্য বেতনের অনভিজ্ঞ হেলপার দিয়ে লঞ্চ চালানোর কারণেই মর্মান্তিক ওই লঞ্চডুবির ঘটনাটি ঘটেছিল।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দৌলতদিয়া লঞ্চ টার্মিনালে সরেজমিন অবস্থান করে দেখা যায়, প্রতিটি লঞ্চ ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে পাটুরিয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই লঞ্চগুলো দৌলতদিয়া লঞ্চ টার্মিনালে ভিড়ছে। এ সময় লঞ্চঘাটসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলাচলকারী লঞ্চগুলোর মধ্যে ‘ফাতেহা নূর’ ও ‘খন্দকার-১’ নামের দুটি লঞ্চের বর্তমান অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বডির গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভেঙে পড়া সত্ত্বেও বিআইডাব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে লঞ্চ দুটি চলাচল করছে। সত্যতা স্বীকার করে লঞ্চ ফাতেহা নূরের চালক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ইঞ্জিন ঠিক আছে, তবে বডি মেরামতের জন্য আমাদের লঞ্চটি আগামী মাসেই নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে পাঠানো হবে।’
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ছোট-বড় ৩৩টি লঞ্চ সার্বক্ষণিক সচল রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নেই। বর্তমান সেখানে মাত্র ১৭টি লঞ্চ দিয়ে কোনো রকমে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। অন্য লঞ্চগুলো পাঠানো হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মানিকগঞ্জের আরিচা ও পাবনার কাজীরহাট নৌ রুটে। কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, আরিচা লঞ্চ মালিক সমিতির মাধ্যমে এ নৌপথের সব লঞ্চ পরিচালিত হয়। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম খান ওই লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর ভাগ্নে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলাচলকারী সব ফেরিযাত্রীর টিকিট বিক্রির ইজারাদার। তাই অধিক মুনাফা লাভের আশায় লঞ্চের চেয়ে ফেরিতে বেশি যাত্রী পারাপার করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে তৎপর রয়েছেন রহিম খান। এ ক্ষেত্রে সমিতিভুক্ত অন্য লঞ্চ মালিকদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে কৌশলে আরিচা-কাজীরহাট রুটে বেশিসংখ্যক লঞ্চ পাঠিয়ে তিনি ব্যস্ততম দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌ রুটে লঞ্চের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন। ফলে যাত্রী কমে যাওয়ায় সাধারণ লঞ্চ মালিকরা খরচ পোষাতে বিআইডাব্লিউটিএর কর্মরত কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্তি যাত্রী বহন করে আসছেন। এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে আরিচা লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম খানের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
বিআইডাব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি লঞ্চ সার্ভে করে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় নৌপরিবহন অধিদপ্তর। ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া নৌপথে লঞ্চ চলাচলের কোনো সুযোগ নেই।’ তবে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে উভয় ঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে কর্মরত ট্রাফিক পরিদর্শকদের গাফিলতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। সৌজন্যে-দৈনিক কালের কণ্ঠ।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়