গেলেই মেলে জামা, জুতা, ব্যাগ ! রাজবাড়ীতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ “মানবতার কর্ণার”-
- Update Time : ১০:০৫:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
- / ১১ Time View
জাহাঙ্গীর হোসেন, রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :
গত বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে জেলা শহরের রাজবাড়ী সরকারী টাউন মক্তব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতেই দেখা গেল একটি ভবনের বারান্দায় ঝোলানো রয়েছে প্যান্ট, শার্ট, স্কুল ড্রেস ও সোয়েটার। তার নিচে থাকা একটি ব্রেন্সিতে রয়েছে স্কুল ব্যাগ, মুজা, জুতাসহ অন্যান্য জামা কাপড়। এর উপরে লেখা রয়েছে “মানবতার কর্ণার”। সেখানে আসছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তাদের কেউ কেউ সেখানে অর্ধ পুরোনো জামা-কাপড় ও জুতা-মুজা রেখে দিচ্ছে এবং কেউ কেউ প্রয়োজন অনুযায়ী তা নিয়ে যাচ্ছে।
সেখানে জামা-কাপড় রাখতে আসা অভিভাবক নার্গিস আক্তার বলেন, তার ছেলে এবার ক্লাস ফোর-এ উঠেছে। ফলে ছেলে তৃতীয় শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় তৈরী করা স্কুল ড্রেসের শার্ট এবং জুতা ছোট হয়ে গেছে। এগুলো ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোন গতি ছিলো না। তবে বিকল্প পথ সৃষ্টি করেছেন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা বলেছেন, ওই সব ছোট সাইজের জামা কাপড় ও জুতা ফেলে দেবার দরকার নেই। ওগুলো বিদ্যালয়ের মানবতার কর্ণারে জমা দিতে। তাই তিনি সেগুলো এনে এখানে জমা দিয়েছে।
ওই কর্ণার থেকে স্কুল ড্রেস নেয়া এক অভিভাবক বলেন, তারা খুবই দরিদ্র। স্কুল ড়্রসে বানিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। যে কারণে তিনি স্কুলে এসেছেন এবং বেছে বেছে তার ছেলের শরীরের মাপের স্কুল ড্রেস ও জুতা নিয়েছেন। তার ছেলে এখন থেকে স্কুল ড্রেস ও জুতা পায়ে বিদ্যালয়ে আসবে। বিষয়টা কিছুটা কষ্টের হলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ।
সেখান থেকে স্কুল ব্যাগ নেয়া অপর অভিভাবক বলেন, একটি স্কুল ব্যাগের দাম প্রায় পাঁচশত টাকা। মেয়ের বাবা রিকশা চালিয়ে যা আয় করে তা দিয়ে পাঁচ জনের সংসার পরিচালনা করাই কষ্টের। তার উপর তিন ছেলে মেয়ের পড়াশোনার ব্যয় চালানো কষ্টকর। মেয়েটার স্কুল ব্যাগ ছিড়ে গেছে অনেক দিন। তবে কেনা হয়নি। স্কুল থেকে শিক্ষকরা বললেন, কোন সমস্যা নেই মানবতার কর্ণার থেকে স্কুল ব্যাগ নিয়ে যেতে। তিনি তাই করেছেন। মেয়ের জন্য পছন্দমত স্কুল ব্যাগ নিয়ে গেছেন। মেয়ে এখন থেকে ওই ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে আসবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জুন কক্স বলেন, মানবতার কার্ণার স্থাপনের ধারনাটা রাজবাড়ী সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসরিন আক্তারের। তারা তার ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। তার এ বিদ্যালয়ে দুই সহ¯্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। জেলা শহরের অন্যতম এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উচ্চ বৃত্ত পরিবারের সন্তানদের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও এখানে পড়াশোনা করে। এই কর্ণার স্থাপনের আগে দরিদ্র পরিবারের বেশির ভাগ শিশুই স্কুল ড়্রেেসর সোয়েটার ও জুতা পরে আসতো না। ওই সব শিশু ও তাদের অভিভাবকদের বলার পরও শিশুরা তা পরে আসতো না। অভিভাবকরা বলতেন টাকা পাবেন কোথায়। যে কারণে শিক্ষকরা কিছুটা হতাশ হতেন। তবে এই উদ্যোগের ফলে তারা সুফলতা পেয়েছে। মাত্র এক মাসের মধ্যে তারা শতভাগ শিক্ষার্থীকে স্কুল ড্রেস পড়া অবস্থায় বিদ্যালয়ে পাচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, শুরুতেই কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। বৃত্তবান অভিভাবকদের বোঝাতে হয়েছে। তবে এখন আর তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। যে সব শিশু জামা, জুতা, স্কুল ব্যাগ, জ্যামেতি বক্সসহ পরিধেয় অন্যান্য পোশাক পরিবর্তন করছে তারা তা ফেলে না দিয়ে এই কর্ণারে এনে জমা দিচ্ছে। আর যে সব অভিভাবক ও শিক্ষার্থী এ সব নিচ্ছেন তাদের বলা হয়েছে, এ সব নেবার জন্য কারও অনুমতি লাগবে না, কেউ সংকোজ ও বোধ করবেন না। এ সব প্রয়োজনমত নেবেন এবং নিজেদেরটাও ফেলে না দিয়ে এখানে জমা দেবেন।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসরিন আক্তারের বলেন, সদর উপজেলার ১৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শহরের চাইতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয় গুলোতে দরিদ্র শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। ফলে অনেক শিক্ষার্থীকের এখনো স্কুল ড্রেস পড়া অবস্থায় পাওয়া যায়না। যে কারণে তিনি বিকল্প একটি পথ তৈরীর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন। যার অংশ হিসেবে এ “মনবতার কর্ণার” স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮০ ভাগ বিদ্যালয়ে ওই কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শিশুরা দ্রুত বড় হয়। ক্লাস ওয়ানের শিশু ক্লাস থ্রি-তে ওঠার পর আর তার ওই স্কুল ড্রেস অথবা জুতা পরতে পারে না। তারা নতুন ড্রেস তৈরী ও জুতা কিনে থাকে। পুরোনো গুলে ফেলে দেয় অথবা অনাদর অযন্তে ঘরের কোন ফেলে রাখে। অথচ ওই সব ড্রেস ও জুতা নতুবা অন্যান্য কাপড়-চোপড় মানবতার কর্ণারে প্রদান করা হলে তা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপকারে আসে। তারা তা নিয়ে পড়তে পারে। বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাও সঠিক থাকে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দা নুর মহল আশরাফি বলেন, চলতি বছরের ১ জানুয়ারী থেকে ওই কর্ণারটি চালু করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সুফলতা আসতে শুরু করেছে। কর্ণার গুলো পরিদর্শন করে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী প্রশংসা করেছেন। তিনি মনে করেন, দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়েই এ ধরণের কর্ণার স্থাপন করা হলে অভুতপূর্ব সারা যাওয়া যাবে। দরিদ্র শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কারও কাছে হাত পাততে হবে না। শিশুরা আনন্দসহ বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা ও পাঠ গ্রহণ করতে পারবে।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
পাঠক প্রিয়